মেহেরপুরের হারদা পাটাপুকুর খামারে নৃশংসতা : আড়ালে পুরোনো বিরোধ নাকি আধিপত্য বিস্তার
ঘটনাস্থল থেকে ফিরে মাজেদুল হক মানিক/আবু সুফিয়ান: মেহেরপুর সদর উপজেলার পাটাপুকুর খামার পাহারাদার নিজাম উদ্দীনকে (৪৫) নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। গত শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত কোনো এক সময়ে তাকে হত্যা করা হয়। গতকাল শনিবার সকালে স্থানীয়রা খামার পার্শ্ববর্তী গাংনীর কষবা বড় খালে জাগ দেয়া পাটের নিচ থেকে তার লাশ উদ্ধার করেন। পরে লাশ মর্গে প্রেরণ করে পুলিশ। নিজাম উদ্দীন গাংনী উপজেলার কষবা গ্রামের মৃত মোজাজ্জেল হোসেনের ছেলে। এক সময় চরমপন্থি দলের সাথে সম্পৃক্ততা ছিলো নিজাম উদ্দীনের। এ ঘটনার জের ধরে অথবা পাহারা কেন্দ্র করে কোনো দুর্বৃত্তদলের অসুবিধার জের ধরে সে খুন হতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। এ তথ্য জানিয়ে গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাছুদুল আলম বলেছেন, দ্রুততম সময়ে হত্যাকাণ্ডের জট খুলতে পারে।
স্থানীয় ও পুলিশসূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার সিংহাটি গ্রামের কাওছার আহম্মেদের খামার পাহারা করতেন নিজাম উদ্দীন। সাথে আরও কয়েকজন একই কাজে নিয়োজিত ছিলেন। গত শুক্রবার মধ্যরাতে একদল দুর্বৃত্ত খামারে হানা দেয়। খামার ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেনকে একটি কক্ষে আটকে রেখে নিজাম উদ্দীনকে ধরে নিয়ে যায়। অপর একজন পাহারাদার পালিয়ে গিয়ে খামার মালিককে খবর দেয়। খবর পেয়ে রাতেই বারাদি পুলিশ ক্যাম্পের এসএসআই মোস্তফা কামাল সঙ্গীয় সদস্যদের নিয়ে ঘটনাস্থলে এসে আলমগীরকে মুক্ত করেন। পাহারাদারদের সাথে নিয়ে তিনি আশেপাশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক খুঁজেও কোনো হদিস মেলাতে পারেননি।
খামার ব্যবস্থাপক আলগমীর হোসেন জানিয়েছেন, খামারের দুটি পাশাপাশি কক্ষে তারা দুজন শুয়ে থাকেন। নিজাম উদ্দীনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা তাকে বোমা দেখিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। নিজাম উদ্দীন ও তার মোবাইল দুটি কেড়ে নিয়ে তাকে ঘরের দরজা বন্দি করে রাখে। তবে কারা এ দুর্বৃত্তরা তা তিনি চেনে না বলে জানিয়েছেন।
নিহতের স্ত্রী নাছিমা খাতুন জানিয়েছেন, বেশ কয়েক বছর থেকেই এ খামার পাহারা করছেন নিজাম উদ্দীন। সহায় সম্বলহীন পরিবারের সব খরচ চলে নিজাম উদ্দীনের নৈশপ্রহরীর চাকরি থেকে। শরীরে পক্স ওঠায় কয়েকদিন থেকেই তিনি বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। শনিবার সন্ধ্যা থেকেই খামার ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেন কয়েকবার মোবাইলে কল করে কাজে যেতে বলেন। রাত ১১টার দিকে গ্রামের (কষবা) পুলিশ ক্যাম্পে হাজিরা দিয়ে খামারে যায় নিজাম উদ্দীন। পরে রাতে তারা খবর পায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিজাম উদ্দীনকে। হত্যাকাণ্ডের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে থেকেই নিজাম উদ্দীন জানিয়েছিলেন এলাকার কিছু মানুষ তার পেছনে লেগেছে। বিল পাহারা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতেও নিষেধ করেছে তারা। এর জের ধরেই সে খুন হতে পারে বলে ধারণা করছেন নিহতের স্বজনরা।
সদর উপজেলার সিংহাটি গ্রামের উত্তরে এবং গাংনী উপজেলার কষবা গ্রামের দক্ষিণে পাটাপুকুর খামার, কষবা খাল-বিল ও হারদা বিলের অবস্থান। কষবা গ্রাম থেকে ২/৩ কিলোমিটার দূরত্বে এ খামারের অবস্থান। সিংহাটি গ্রাম থেকে খামার পর্যন্ত পাকা সড়ক থাকলেও কষবা গ্রামের সংযোগ সড়কটি কাঁচা। সব মিলিয়ে একটি দুর্গম এলাকা বললেও ভুল হবে না। এলাকার মানুষ এমনই মন্তব্য করে বলেছেন রাতে এ এলাকায় কোনো ঘটনা ঘটিয়ে সহজেই দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের বোঝারও সুযোগ নেই।
এদিকে গতকাল সকালে লাশের খবর পেয়ে বারাদি পুলিশ ক্যাম্প ও গাংনী থানা পুলিশের দুটি দল ঘটনাস্থলে আসেন। ঘটনাস্থলটি গাংনী উপজেলা সীমানায় হওয়ায় গাংনী থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্ত শেষে গতরাতে নিজ গ্রামে নিজাম উদ্দীনের দাফন সম্পন্ন হয়। সকালেই ঘটনাস্থল থেকে খামার ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেনকে আটক করে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাংনী থানার ওসি। গতকালই নিহতের ভাই সেলিম হোসেন বাদী হয়ে গাংনী থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেছেন। তবে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের।
নিজাম উদ্দীনকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বর্ণনা দিতে গিয়ে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী কষবা পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ এসআই আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, লাশ উদ্ধারের সময় দেখা যায় নিজাম উদ্দীনের চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিলো। দু হাতও শরীরের পেছনের দিকে দিয়ে কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিলো। তার লুঙ্গিটি ছিলো গলায় বাঁধা। পরনে একটি গামছা। তবে স্বাশরোধ করে হত্যা নয় তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। মাথায়, কপালে, নাকে ও চোখের ওপরে ধারালো অস্ত্রের গুরুতর আঘাতের কয়েকটি চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাছুদুল আলম জানিয়েছেন, নিজাম উদ্দীন গাংনী থানা পুলিশের তালিকাভুক্ত ১৯ নম্বর সন্ত্রাসী। তিনি কষবা পুলিশ ক্যাম্পে নিয়মিত হাজিরা দিতেন। ২০০৬ সালে কষবার গ্রামের ইউপি সদস্য শুকুর আলীর ওপর বোমা হামলার ঘটনায় তার নামে প্রথম মামলা হয়। পরবর্তীতে আরও দুটি মামলা হয়। তবে ওই সময়ে হাজতমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে চরমপন্থি দলের কোনো সম্পৃক্ততার অভিযোগ নেই। দল ছেড়ে দেয়ায় দলের লোকজন কিংবা প্রতিপক্ষ চরমপন্থিরা তাকে খুন করতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
নিহতের পারিবারিক পরিচয়: নিজাম উদ্দীনের ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে রয়েছে। বড় ও মেজো মেয়ে বিবাহিতা। ছোট মেয়ে তানিয়া স্থানীয় বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। সবার ছোট ছেলে সোলায়মান (৬)। বর্তমানে স্ত্রী ও ছেলে মেয়েসহ তার সংসারের সদস্য ৪ জন। বাড়ি কিংবা মাঠে কোনো সম্পত্তি নেই। পরের ভিটায় বসবাস। নিহতের পরিবার থেকে এ তথ্য দিয়ে আরও জানানো হয় পরিবারের একমাত্র উর্পাজনকারী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। জীবনের শেষ সময়ে এসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পাশাপাশি নৈশপ্রহরীর কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। তাকে হারিয়ে পরিবারের সদস্যরা এখন বড়ই অসহায়।