স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও চলছে। শুধু অবাধ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই নয়, ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও নিরাপত্তাসহ নানা বিষয় ভৌগোলিক কারণেই বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত, সেসব দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরই অধিকতর দৃষ্টি রাখছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনীতিসহ এ অঞ্চলের সার্বিক অগ্রগতির স্বার্থেই স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় প্রতিবেশী দেশগুলো। কারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে এর ব্যাপ্তি ওসব দেশ পর্যন্তও বিস্তৃত হয়। অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি এর কম-বেশি বিরূপ প্রভাব পড়ে ভারত ও চীনসহ এ অঞ্চলের সার্বিক অগ্রগতির ওপরও। তাছাড়া এ অঞ্চলের যে কোনো রাষ্ট্রেই ধর্মীয় বা অন্য কোনো উগ্রপন্থী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে ভৌগোলিক কারণেই তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সবার জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে, এসব দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় ছেদ ফেলে। মূলত এসব পারস্পরিক সম্পৃক্ততার কারণেই প্রতিবেশীরাও বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা চায়।
ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যম গত সোমবারের নিবন্ধসহ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুনের বুধবারের মন্তব্য পর্যালোচনা করলেও বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গত সোমবার একটি সংবাদমাধ্যমে হোয়াট দিল্লি মাস্ট সে, হোয়াট ঢাকা নিডস টু হেয়ার শিরোনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে নয়াদিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো সি. রাজা মোহন লিখেছেন ভারত যদি প্রতিবেশী বাংলাদেশকে দেয়া প্রতিশ্রুতি না রাখে এবং এর ফলে শেখ হাসিনার সরকার পরিবর্তিত হয়, তাহলে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থানে সক্রিয়ভাবেই দায় থাকবে ভারতের। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে যখন জিহাদি রাজনীতি সক্রিয় হচ্ছে সেই সময়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে একই ধরনের সন্ত্রাসবাদের উত্থান হবে ভারতের জন্য আত্মঘাতী।
ভারতীয় গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত আরও কয়েকটি প্রতিবেদন ও নিবন্ধেও বাংলাদেশে আগামীতে সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনার সাথে আঞ্চলিক অগ্রগতি ও নিরাপত্তার বিষয়টিকেই অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিবেদন-নিবন্ধের কোন কোনটিতে ভারতের স্বার্থেই শেখ হাসিনার সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়ার জন্য দিল্লি সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জুন গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের কাছে দেয়া বক্তব্যে চীনকে বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে চীন আন্তরিকভাবেই আশা করে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বিরোধের নিরসন হবে এবং এর ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচন সম্পর্কে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং এই অঞ্চলের রাষ্ট্রদূত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বক্তব্য-মন্তব্য গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, আঞ্চলিক অগ্রগতির জন্য তারা স্থিতিশীলতাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য বিদ্যমান, সেটিও নিশ্চয়ই তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। এটা অনুমেয় যে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানে বিদ্যমান ব্যবস্থা বহাল থাকলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে, নাকি এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হলে স্থিতিশীলতা থাকবে সেটিও প্রতিবেশী দেশগুলোর বিবেচনায় রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অভিজ্ঞদের বিশ্লেষণ মতে, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার সাথে অন্য যেসব দেশের স্থিতিশীলতা সরাসরি সম্পৃক্ত, তাদের চিন্তা-ভাবনারই প্রভাব পড়বে এখানকার আসন্ন রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। এর বাইরে অন্যরা যারা বাংলাদেশে শুধু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছে, তাদের বক্তব্য কতটুকু কার্যকারিতা রাখবে তা চিন্তা-ভাবনার বিষয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আঞ্চলিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ও পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধে আপাতদৃষ্টিতে সংকটে থাকলেও আঞ্চলিক রাজনীতির হিসেবে শেখ হাসিনার সরকার কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।