অর্থলিপ্সুতার কাছে ধুলিস্যাত হচ্ছে মূল্যবোধ

একজন মা কখন তার সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে আত্মগোপন করে? একাধিক কারণ থাকতে পারে। আমাদের সমাজে মূলত দুটি জবাব মেলে। একটি হলো- সন্তানের পিতৃপরিচয় নিয়ে লজ্জা, অপরটি হলো অভাব? চুয়াডাঙ্গা রেলবস্তির শিউলী খাতুন বিউটি তার সন্তান অন্যের কোলে তুলে দিয়েছে অভাবের কারণে। যে দেশের সাংবিধানিকভাবে সরকার অন্য বস্ত্র বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করবে, সেই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকারের বিষয়টি অতো সহজ নয়। সকল নারীকে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে পারলে কোনো মা কি তার সন্তানকে অন্যের কোলে ঠেলে দেবে?

 

গর্ভজাত সন্তানকে যে মা অন্যের কোলে তুলে দিয়ে নিজেকে আড়াল করেছেন তার নিকট সমাজের দায়বদ্ধতা অনেক। সমাজ তার মাতৃত্বের মায়া বুঝতে পারেনি। একজন অবশ্য কিছুটা বুঝেছেন বলেই সদ্য ভুমিষ্ঠ তার পুত্রসন্তানের সাথে সাথে ওই কন্যা নবজাতককে নিজের সন্তান হিসেবে লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছেন। তা নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছে। দুজন নারী নবজাতককে নিয়ে ঢাকার পথে পাড়ি জমান। অভিযোগ, শিশুকে পাচার করা হচ্ছিলো। এ অভিযোগ তুলে পালিত মা চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় মামলা দায়ের করেছেন। অভিযুক্ত দু নারীকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্তে শিশুপাচারকারীচক্রের মুখোশ খুলবে বলেই বিশ্বাস। কিন্তু এ চিত্র কি এ সমাজের হওয়া উচিত। একজন মা তার সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছেন অভাবের কারণে, আবার সেই নবজাতককে নিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠছে অন্য নারী। এসব দেখে বলতেই হয় নীতি-নৈতিকতার পতন ঘটেছে। অভাব কাড়ছে মাতৃত্বের মায়া, অর্থলিপ্সুতার কাছে ধুলিস্যাত হচ্ছে মূল্যবোধ। স্বাধীনতার এতোগুলো বছর পেরিয়েও আমরা আমাদের সমাজকে তথা দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিতে পারিনি। পারতে হবে। নানা নামে, নানাভাবে ভাতা দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে কি? বিতর্ক আছে।

 

দারিদ্র্য বিমোচনের পথে যে আমরা একেবারেই এগোতে পারিনি তাও নয়, তবে তা যথেষ্ট নয়। দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে না পারলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর গতি বাড়ে না, বাড়ছে না। শুধু রেলের জমিতে নয়, বড় বড় সড়কের পাশের জমিতে রাতারাতি গড়ে উঠছে বস্তি, মাঝে মাঝে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। উচ্ছেদ আতঙ্ক তাদের ঘুম কেড়ে নেয়। পুনর্বাসন কর্মসূচি থাকলেও তা যে পর্যাপ্ত নয় তাও অস্বীকার করার জো নেই। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বনির্ভরতার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ সৃষ্টির দায়িত্ব রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের ওপরই বর্তায়। ভাবতে হবে সমাজকে, ভাবতে হবে সমাজ পরিচালনাকারীদের।