রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ে নতুন ভাবনা জরুরি

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা ভালো নয় বলে স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি আরো বলেছেন, পত্রিকায় এসব ব্যাংকের খারাপ অবস্থার কথা লেখা হচ্ছে বলেই সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে এসব ব্যাংকে আরো অর্থ সুবিধা প্রদানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর স্বীকারোক্তিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ক্রমেই খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর নেপথ্যে কী কারণ রয়েছে, তা উদঘাটিত না করলে কেবল পুঁজি সরবরাহ করলে পরিস্থিতির কখনো উন্নতি হবে না। যদিও সরকারি ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি করা হয়েছে, সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে; কার্যত এখন পর্যন্ত কোনোটারই সুফল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং দেখা গেছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বেড়েছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের অঙ্ক। নানান অনিয়ম আর জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনাও নতুন নয়।

সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক ও দু বিশেষায়িত ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যানদের সাথে বৈঠক করে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো নয়। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সার্বিক অবস্থাও তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা গেছে, এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। চলতি বছরের জুন শেষে ছয়টি ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৪শ ৫ কোটি টাকা। এছাড়া বিভিন্ন অনিয়মের কারণে কয়েকটি ব্যাংক ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংকগুলোর এ খারাপ অবস্থার কারণে দেশের রাজস্ব ও আর্থিক খাত ঝুঁকিতে পড়েছে বলে ইতঃপূর্বে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা (আইএমএফ)। কিন্তু দিনের পর দিন কেন এমন অবস্থা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় নিয়োগ, বদলি-পদোন্নতিতে অনিয়ম স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। পরিচালনা পরিষদ সদস্য নিয়োগেও যথাযোগ্য লোককে বাছাই করা যায়নি। যার ফল হিসেবে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেই চলেছে। এরপরও নীতিনির্ধারকদের টনক নড়েনি দেখে সমালোচকরা বলে থাকেন, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলো সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকদের সুবিধা দেয়ার জন্যই চালু রাখা হয়েছে।

স্বাধীনতার পর ব্যাংকগুলোকে জাতীয়করণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে বেসরকারি খাতেও যখন ব্যাংক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তখন জনগণকে বাড়তি সেবা দেয়ার জন্যই রাষ্ট্র নিজের কাছে কিছু ব্যাংক রাখার তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু দেখা গেছে, রাষ্ট্রের কাছে থেকে যাওয়া এসব ব্যাংক কেবলই লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বিভিন্ন সময় দলীয় কিংবা গোষ্ঠীগত লোকদের সুবিধা দেয়ার জন্যই যেন এ ব্যাংকগুলো পরিচালনা করা হয়েছে। যখন যেই সরকার ক্ষমতায় থাকবে, সেই সরকারই যেন তাদের নিজেদের লোকদের সুবিধা দিতে এসব ব্যাংক ব্যবহার করবে। আর এ নীতির কারণেই আমরা দেখি সমসময়ে বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনার পেছনে প্রভাবশালীদের হাত রয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। আর তাই যদি হয় তবে ব্যাংকগুলো কীভাবে ভালো করে চলবে। বরং ব্যাংকগুলোর অবস্থা খারাপ হবে, নতুন করে সরকার অর্থ যোগান দিয়ে যাবে- এটাই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এবারেও অর্থমন্ত্রী সেই কথাই বলেছেন। তার মতে, ব্যাংকগুলোকে ৫ হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ যোগান দিতে হবে। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক নয় যে, এভাবে আর কতোদিন চলবে? জনগণের আমানতের টাকা কিংবা করের টাকা এভাবে নষ্ট হতে দেয়া যায় কি? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আবশ্যিক এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিয়ে নতুন চিন্তা জরুরি বলে আমরা মনে করছি।