শিক্ষাবোর্ডের অনলাইনে শিক্ষার্থীদের তথ্য প্রেরণ : চুয়াডাঙ্গার সরকারি দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
আনজাম খালেক: চুয়াডাঙ্গার দুটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নাম অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের নামে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা আদায় করছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। সাংবাদিকরা জানার পর সরকারি দুটি স্কুল একটু নড়েচড়ে বসেছে। তারা ছাত্রছাত্রীদের টাকা গোপনে ফেরত দিতে শুরু করলেও বলেছে পরে নেয়া হবে। তবে এ জন্য শিক্ষাবোর্ড বা সংশ্লিষ্ট কোথাও এক টাকাও খরচ নেই বলে জানিয়েছেন বোর্ড কর্মকর্তা।
সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসের ৩১ তারিখে যশোর শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিসহ নবম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীর তথ্য অনলাইনে দেয়া হয়। এ জন্য বোর্ড বা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কোথাও এক টাকাও নেয়নি। বিনামূল্যে এসব তথ্য অনলাইনে দেয়ার জন্য বোর্ড কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ছিলো। শিক্ষার্থীদের ছবিসহ তাদের তথ্য উপাত্ত অনলাইনে দিতে ইন্টারনেট খরচ হিসেবে আনুমানিক ৪/৫ টাকা খরচ হতে পারে বলে অনলাইন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা সরকারি ভি.জে উচ্চ বিদ্যালয় ও চুয়াডাঙ্গা সরকারি মাধ্যমিক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২০০ টাকা হারে আদায় শুরু করলে অভিভাবক মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অভিযোগ পেয়ে গত (সোমবার) ১৯ আগস্ট এই প্রতিবেদক সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলে প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হোসেন উজ্জ্বল বলেন ‘বোর্ডের মৌখিক অনুমতি আছে ১২০ টাকা নেয়ার। কিন্তু আমরা নিচ্ছি ২০০ টাকা করে।’ যশোর বোর্ড কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানায়, এ জন্য কোনো টাকা নেয়ার বিধান নেই। এটা বিনামূল্যে করতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বালিকা বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঁচ শতাধিক ছাত্রী রয়েছে। তাদের কাছ থেকে ২০০ টাকা হারে আদায় হলে লক্ষাধিক টাকা আদায় হবে। এই অবৈধ টাকা কালেকশনের শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছে বালিকা বিদ্যালয়। অবৈধ টাকা আদায়ের বিষয়টি জানাজানি হলে গতকাল ছাত্রীদের টাকা গোপনে ফেরত দেয়া হয় এবং বলা হয় পরে টাকা নেয়া হবে। অন্যদিকে নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনের নির্দেশনা না এলেও তাদের কাছ থেকে ৩০০ টাকা হারে অবৈধভাবে আদায় করা হচ্ছে।
অন্যদিকে চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েও একই কায়দায় একই হারে অবৈধভাবে টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ স্কুলের ছাত্রদেরকেও গতকাল টাকা ফেরত দেয়া হয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক শরিফ উদ্দিন বিশ্বাস জানান, মৌখিকভাবে টাকা আনার কথা বলা হলেও টাকা নেয়া হয়নি। ছাত্র ও অভিভাবকরা টাকা নিয়ে এলেও তা ফেরত দেয়া হয়। এ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২৮০ জন এবং সপ্তম শ্রেণিতে ২৫০ জন ছাত্র। এদের কাছ থেকে ২০০ টাকা আদায় হলে ১ লাখ ৬ হাজার টাকা আদায় হতো। একইভাবে নবম শ্রেণির আড়াইশ ছাত্রের কাছ থেকে ৩শ টাকা হারে নিলে হতো ৭৫ হাজার টাকা। অভিভাবক মহলের প্রশ্ন অবৈধভাবে এসব টাকা আদায় করে কী করা হতো? তারা অভিযুক্ত সরকারি দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানান।
অন্যদিকে, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা একাডেমী ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ছাত্রদের কাছ থেকে ১৫০ টাকা হারে অবৈধভাবে আদায় করা হয়েছে। এ অভিযোগ পেয়ে প্রধান শিক্ষক সুকেশ কুমারের কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এটা আমাদের ইন্টারনাল ব্যাপার। এ বিষয়ে আপনাদের কী?
এদিকে একই কার্যক্রম পরিচালনা করতে চুয়াডাঙ্গা আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে মাত্র ৫ টাকা করে। প্রধান শিক্ষক বিলকিচ জাহান দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানান, যেহেতু টাকা নেয়ার নির্দেশনা নেই, তাই ইন্টারনেট খরচ ও আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবে এই ৫ টাকা করে নেয়া হয়েছে। রাহেলা খাতুন গার্লস একাডেমীর প্রধান শিক্ষক আমিরুল ইসলাম জানান- এ কাজে নেয়া হয়েছে ছাত্রী প্রতি ১০০ টাকা। হাজরাহাটি-তালতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, আমরা সব মিলিয়ে ২০ টাকা করে নিয়েছি ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। এমএ বারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক একেএম আলী আখতার জানান, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২৫ টাকা হারে নেয়া হয়েছে। যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির একই কার্যক্রম পরিচালনা করতে চুয়াডাঙ্গা শহরের স্কুলগুলোর টাকা আদায়ের এই বিশাল ব্যবধান অভিভাবক মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।
দামুড়হুদা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুর জাহান খাতুন জানান, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আমরা ২০ টাকা করে নিয়েছে। এর মধ্যে ১০ টাকা করে তাদের ব্লাড গ্রুপিঙের জন্য ব্যয় করেছি। তবে কোনো কোনো স্কুলে বেশি টাকা নেয়ার অভিযোগও আছে। এ ব্যাপারে দামুড়হুদা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ কুমার সাহা জানান, দামুড়হুদার ২৭টি মাধ্যমিক ও ছয়টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। তবে অতিরিক্ত টাকা নেয়ার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
আলমডাঙ্গার আইলহাস লক্ষ্মীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাইজাল হোসেন জানান, অনলাইনে কার্যক্রম ফ্রি করার কথা। কিন্তু যেহেতু আমাদের বিদ্যালয় মফস্বলে অবস্থিত এবং এখানে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সুবিধা না থাকায় বাইরে থেকে আমাদের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এ কারণে আমরা মাথা পিছু ২৫ টাকা হারে গ্রহণ করেছি।
জীবননগর উপজেলার ২২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ছয়টি মাদরাসার ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বোর্ডে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। ৯ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জীবননগর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যাদব কুমার প্রামাণিক জানান, এ কাজের জন্য বোর্ডে ছবি ও তথ্য প্রেরণ করতে তারা ২৫ টাকা এবং রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করতে ২৫ টাকা করে নিয়েছিলেন। উপজেলার কাশিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় এ কাজের জন্য শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে ৩শ টাকা করে আদায় করে। এ নিয়ে দৈনিক মাথাভাঙ্গায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পরে অবশ্য শিক্ষার্থীদের ১২০ টাকা হারে ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু; তারপরও এ কাজের জন্য তারা অতিরিক্ত টাকা কেটে রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা অফিসার খন্দকার আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, বিদ্যালয়ের এসব কার্যক্রম সরাসারি শিক্ষাবোর্ড থেকে পরিচালনা করা হয়। তবে যেহেতু অভিযোগ উঠেছে, আমরা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবো।
জেলা প্রশাসক দেলোয়ার হোসাইন বলেন, দুটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা অন্য কেউ এ ব্যাপারে আমার সাথে আলাপ করেননি। কেউ অভিযোগও করেনি। তবে যেহেতু অভিযোগ উঠেছে অবশ্যই এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।