স্টাফ রিপোর্টার: আইন বিশেষজ্ঞ এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের কঠোর সমালোচনার মুখে তড়িঘড়ি করে অধ্যাদেশ জারি করে আইনে পরিণত করা হলো তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত সংশোধন। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল বুধবার বিকেলে জানান, সংশোধনটি অধ্যাদেশ হিসেবে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এখন থেকে এটি আইনে পরিণত হবে। পরে এটি সংসদে তোলা হবে। সংসদের অধিবেশনের তারিখ ঘোষণার পর কেন এতো দ্রুত অধ্যাদেশ জারি করে আইনে পরিণত করা হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। অধ্যাদেশ জারির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, যে আইনে বাকস্বাধীনতা কিংবা মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার প্রশ্ন ওঠে, তা অবশ্যই অধ্যাদেশ জারি করে কার্যকর করা উচিত নয়। তথ্যপ্রযুক্তি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আনিক আর হক বলেন, এখন তো এ অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে মতামত দেয়াও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেলো। যেকোনো মতামতকেই সরকার মানহানিকর কিংবা উসকানিমূলক উল্লেখ করে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করতে পারে। সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের ধারার সাথে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে বিষয়টি উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলেও জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা। তবে তথ্য ও যোগাযোগ সচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, সংশোধনটি করা হয়েছে মূলত অনলাইনে অশ্লীল ছবি কিংবা ভিডিওচিত্র দিয়ে নারীর সামাজিক মর্যাদাহানি রোধ করার জন্য। এ সংশোধন স্বাধীন মতামত প্রকাশে বাধা হবে না বলেও মত দেন তিনি।
আইন সংশোধনের পটভূমি: সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, কয়েক মাস ধরে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ব্যবহার করে সরকারবিরোধী বিকৃত তথ্য ও ছবি প্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই এ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক গতিতেই চলছিলো। তবে সর্বশেষ এ সংশোধনের জন্য জোরালো উদাহরণ হিসেবে ভূমিকা রাখে কিছুদিন আগে জনপ্রিয় একটি ব্লগের একজন কর্ণধারের বিকৃত ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা। তার ছবি ফটোশপে অন্য অশ্লীল ছবির সাথে জুড়ে দিয়ে একটি অসাধুচক্র প্রচার করলে তিনি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রতিকার চান। এরপরই ২০০৬ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া দ্রুতগতি লাভ করে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী, বিশেষজ্ঞ এবং আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাড়াই আইন সংশোধনের খসড়া তৈরি হয়। পরে তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পছন্দ অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কয়েকটি বৈঠক করা হয়। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সরকারি টাস্কফোর্সের সবাইকে এ আইন সংশোধনের বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একক তত্ত্বাবধানে আইন সংশোধনের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিসভায় পাঠানো হয়। মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়ার দিনেই পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শাখা ভেটিং করে অধ্যাদেশ জারির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠালে তা স্বাক্ষর হয়ে গতকাল বুধবার গেজেট হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
তবে আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায় যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা জানান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, সংশোধনে আইনের মূল সংজ্ঞা, নির্দেশনার কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি। শুধু সর্বোচ্চ শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ১০ বছরের স্থলে ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন শাস্তি সাত বছর করা হয়েছে। এছাড়া যেসব ক্ষেত্রে মামলা করতে পুলিশের পূর্ব অনুমোদন নেয়ার ব্যবস্থা ছিলো, সেগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে অপরাধকে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উসকানিমূলক বক্তব্য, মানহানিকর তথ্য কিংবা কুৎসা রটনা জাতীয় অস্বচ্ছ শব্দগুলো (যেগুলোর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয়া যায় না) সংযোজনের ব্যাপারে তিনি বলেন, এসব শব্দ থাকার অর্থ এই নয় যে, এর মাধ্যমে সমালোচনা করার অধিকার কিংবা স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার খর্ব হবে। এ আইনের অপপ্রয়োগ হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাওয়ার অধিকারও নাগরিকের থাকবে।
কঠোর প্রতিক্রিয়া সব মহলে: প্রখ্যাত আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, যে আইনে বাকস্বাধীনতা কিংবা সংবিধানের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার প্রশ্ন ওঠে, সে আইন কার্যকর করার জন্য অধ্যদেশ জারি করা উচিত নয়। এটি অবশ্যই সংসদে উপস্থাপন করে, স্ট্যান্ডিং কমিটি যাচাই-বাছাই করে, সংসদে আবারও আলোচনা করে, প্রয়োজনে জনমত যাচাই করে করা উচিত ছিলো। এখন আইনের সংশোধন এবং অধ্যাদেশ জারি_ দুটিই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আইন ও সালিস কেন্দ্রের প্রধান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, প্রথমত সুসভ্য কোনো আইন জামিন অযোগ্য হতে পারে না, এটা সরাসরি মানবাধিকারের পরিপন্থি। আদালতের প্রতি বিশ্বাস থাকলে জামিনের বিষয়টি আদালতের ওপর ছেড়ে দেয়াটাই আইনের সঠিক অবস্থান। গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়া গ্রেফতারের বিষয়টিও মানবাধিকারের পরিপন্থি। তিনি বলেন, অধ্যাদেশ জরুরি প্রয়োজনে সরকার জারি করতে পারে, যেমন- পাকিস্তান আমলে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ হিসেবে এসেছিলো। কারণ সে সময় সংসদে গেলে এটা পাস হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিলো। আগামী সেপ্টেম্বরেই সংসদ বসছে। সেখানে আওয়ামী লীগের দুই-তৃতীয়াংশ আর মহাজোটের তিন-চতুর্থাংশ আসন আছে, তাহলে এ অধ্যাদেশ জারির প্রয়োজন হলো কেন। এ অধ্যাদেশ জারি অবশ্যই অনৈতিক হিসেবে বিবেচিত হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আনীক আর হক বলেন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ, সাইবার অপরাধ দমন আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা একই সাথে হয় না। কারণ, এগুলো এক বিষয় নয়। যদি পর্নোগ্রাফি ও অশ্লীলতার মাধ্যমে গুরুতর অপরাধ ঘটে, তার বিরুদ্ধে আইন হতে পারে; কিন্তু এর সাথে মানহানিকর বক্তব্য, উসকানি, কুৎসা রটনাকে যুক্ত করে পুরো আইনকে মত প্রকাশের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন এ আইনের বিরুদ্ধে মত দেয়াকেও উসকানি উল্লেখ করে গ্রেফতার করার সুযোগ থাকছে। এর ফলে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। এ আইন সংবিধানের ৩৯ ধারায় বর্ণিত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। এ আইন উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে গণমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার কর্মী, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী- সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একটি গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের আইন কাম্য হতে পারে না। যে কারও মত প্রকাশের বিরুদ্ধে এ আইনের প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকছে বেশি। সংসদ এখনও আছে, তা সত্ত্বেও এটি কেন অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হলো_ তাও এ আইন সংশোধন নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী আইনজীবী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, সংবিধানের ২৬ ধারায় বাকস্বাধীনতার কথা স্পষ্ট বলা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশোধনে সেই বাকস্বাধীনতাকে রুদ্ধ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ কারণে এ অধ্যাদেশটি উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এ ধরনের অধ্যাদেশ জারি করার আগে সরকারের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মতামত নেওয়া উচিত ছিল।
ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা অবশ্যই পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতা, রুচিহীনতা, ব্ল্যাকমেইলিং, বিকৃত তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে; কিন্তু কখনোই মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয়। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশোধন সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে, আইনটিতে স্বাধীন মত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত করার কিছু বিধান আছে। এর ফলে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, গণমাধ্যমের বিশ্লেষণসহ মতামত প্রকাশ করার ক্ষমতা খর্ব হবে। এ কারণে আইনের সংশোধন এবং অধ্যাদেশ কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়।