গোয়েন্দা পুলিশের কছে ঐশী একজন অপরাধী : সহযোগীসহ মা-বাবার খুনি।
স্টাফ রিপোর্টার: গোয়েন্দা পুলিশের কছে ঐশী একজন অপরাধী। সহযোগীসহ মা-বাবার খুনি। দায়ও স্বীকার করে বলেছে খুন সে করেছে। সেটা আগের পরিকল্পনা, যখন তাকে মা-বাবা কড়া নজরদারিতে নিলো। এটা তার জীবনযাপনে বাধা হলো। পশ্চিমা কালচার অনুসারী ঐশী রহমান মা-বাবার খুব বাধ্য ছিলো না। গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে তার দেয়া তথ্য থেকেই তা জানা গেছে। শনিবার তাকে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। কিন্তু তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন তারা বিতর্কের অবসান ঘটাতে চেয়েছেন। তাই তার শারীরিক পরীক্ষার জন্য গতকাল বুধবার ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। ঐশীর বয়স পরীক্ষার জন্য তার দাতের পরীক্ষা ও হাড়ের এক্স-রে করা হয়।
গোয়েন্দাসূত্র বলেছে, মানবাধিকার সংস্থার পক্ষে আপত্তি তোলার আগেই তারা ঐশীর জন্মবৃত্তান্ত সংগ্রহ করেছেন। চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, বিতর্কের অবসানও হয়েছে ওই তথ্যে। গতকাল বুধবার ঐশীর বয়স হয়েছে ১৯ বছর ৪ দিন। প্রমাণ কি আছে এটা ঐশীর বয়স- এমন প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, বয়স যখন বলেছি তখন সব আছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, ঐশী রহমানের বাবা ১৯৯৪ সালে খুলনায় কর্মরত ছিলেন। ঐশীর জন্ম হয়েছে খুলনাতেই। কোথায় ঐশীর জন্ম হয়েছে- হাসপাতাল বা ক্লিনিকের নাম কি কিংবা ওই সময় কোনো চিকিৎসক ঐশীর মায়ের চিকিৎসা সেবার দায়িত্বে ছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর মিলেছে যথাযথভাবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯৪ সালের ১৭ আগস্ট ঐশী রহমানের জন্ম হয়। তার জন্ম হয় খুলনা প্রেসক্লাব সংলগ্ন একটি ক্লিনিকে, যার নাম মিশু ক্লিনিক। ওই ক্লিনিকের মালিকের নাম আবদুর রহিম। ঐশী রহমানের জন্ম হওয়ার আগে তার মা ওই ক্লিনিকের চিকিৎসক ডাক্তার নাসরীনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। ৯৪ সালের ১৭ আগস্ট প্রসব বেদনা নিয়ে ঐশী রহমানের মা স্বপ্না রহমান মিশু ক্লিনিকে ভর্তি হলে তার নর্মাল ডেলিভারি হয়। গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ডাক্তার নাসরীনের সাথে কথা বলেছেন। তিনি গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছেন, ঐশী রহমানের মা স্বপ্না রহমান তার পেশেন্ট ছিলেন। জন্ম হওয়ার আগ থেকে তিনি তার তত্ত্বাবধান করেন। তিনি ঐশীর বাবা পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমানকেও চেনেন। বলেছেন, মিশু ক্লিনিকে ৯৪ সালের নথি আছে। এগুলো ঘটলে ঐশীর জন্ম তথ্য মিলবে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ মিশু ক্লিনিক থেকে সব তথ্য বের করে আনে। এর ফলে বয়স বিতর্কের অবসান ঘটেবে বলে জানান তদন্তে নিয়োজিত গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তিনি জানান, গোয়েন্দা পুলিশ ঐশীর বয়স জানতে নিজ উদ্যোগেই শারীরিক পরীক্ষা করাতো। যেহেতু বিতর্ক উঠেছে তাই এ কাজটি সম্পাদন করা মামলার জন্য প্রয়োজন। কর্মকর্তা বলেন, আমরা মিশু ক্লিনিকের নথিও পেয়েছি। তা যাচাই করছি।
জন্মস্থান ও সালের উপযুক্ত তথ্য পেয়ে বয়স নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ রিমান্ডে থাকা ঐশী রহমানকে গতকাল বুধবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক কি-না তা জানার উদ্যোগ হিসেবে গোয়েন্দা পুলিশ শারীরিক পরীক্ষার মুখোমুখি করে ঐশীকে। গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঐশী নিজেও আগেই স্বীকার করেছে তার বয়স ১৮-এর বেশি হবে। বাবা-মাকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত মেয়ে ঐশী রহমানকে গোয়েন্দা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর পর তার বয়স নিয়ে প্রশ্ন ওঠে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে। অপ্রাপ্তবয়স্ক দাবি করে ঐশীকে রিমান্ডে নেয়ার সমালোচনা করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। সমালোচনার মধ্যে গতকাল বুধবার বয়স পরীক্ষার জন্য ঐশীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয় ডিবি পুলিশ। অবশ্য অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ও লেভেলের শিক্ষার্থী ঐশীর বয়স ওই বিদ্যালয়ের নথি অনুযায়ী ১৮ বছর হয়নি। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় বয়স গোপন করে স্কুলে ভর্তি করা হয়। কম-বেশি সবার জীবনে এটা ঘটে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, বয়স পরীক্ষার জন্য দুপুরে ঐশীকে নিয়ে আসে গোয়েন্দা পুলিশ। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, দ্রুত এ ফলাফল জানা যাবে। ঐশীর বাবা পুলিশ পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান এবং মা স্বপ্না বেগমের লাশের ময়নাতদন্তও করেছিলেন ডা. সোহেল। তিনি বলেন, বয়স পরীক্ষার জন্য দাঁত দেখা ও হাড়ের এক্স-রে করা হয়। কোন দাঁত কোন বয়সে ওঠে সেটা মেডিকেল পরীক্ষায় ধরা পড়ে। কারণ একেক বয়সে একেকটা দাঁত ওঠে। দাঁতের পাশাপাশি বয়স পরীক্ষায় হাড়ের এক্স-রে থেকে সঠিক বয়স নির্বাচন করা হয়।
রাজধানীর চামেলীবাগে সিআইডি কার্যালয় লাগোয়া ২ চামেলী ম্যানশনের ৬ তলার ৫/বি ফ্ল্যাট থেকে গত ১৬ আগস্ট শুক্রবার রাতে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সহযোগীসহ ঘটনা ঘটানোর পর পুলিশ দম্পতির মেয়ে ঐশী রহমান আত্মগোপন করে। পরে দু সহযোগীর কাছে নিজেকে নিরাপদ না ভেবে আরেক বন্ধু পারভেজের পরামর্শে পরদিন ১৭ আগস্ট শনিবার রাজধানীর পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে। গোয়েন্দারা সেদিনই তাকে নিয়ে অভিযানে নামে। একপর্যায়ে কাজের মেয়ে সুমি ও বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে গ্রেফতার করা হয়। পল্টন থানায় করা মামলায় ঐশী ও কাজের মেয়ে সুমি এবং বন্ধু রনিকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় দুই বন্ধু জনি ও সাইদুলের নাম উঠে আসায় গোয়েন্দা পুলিশ তাদের খুঁজছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ঐশী রহমানের কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তার দু বন্ধুকে গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ। একইসাথে তার কাছে পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
পুলিশ দম্পতি মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যা করে বাসা থেকে অলঙ্কার ও নগদ মুদ্রা নিয়ে পালিয়েছিলো ঐশী। পুলিশের কাছে ধরা দেয়ার আগে বয়ফ্রেন্ড জনির আশ্রয়ে ছিলো সে। সেখান থেকেই তার সাথে থাকা সোনার গয়নাগাটির বেশির ভাগ চুরি হয়েছে। পরে পুলিশ জনির গার্লফ্রেন্ড আইরিনের বাসা তল্লাশি চালিয়ে অলঙ্কারের সাত-আটটি খালি বাক্স উদ্ধার করে। পাশাপাশি ঐশীর একটি ব্যাগ থেকে প্রায় ১০ ভরি সোনার গয়নাগাটি উদ্ধার করে। উদ্ধার করা হয়েছে কিছু বিদেশি মুদ্রা। পুলিশের ধারণা, পুলিশ দম্পতির বাসায় প্রায় ৪০ ভরি সোনা ছিলো। সব অলঙ্কার ঐশী লুট করেছিলো। পরে বাসা থেকে পালিয়ে যাদের আশ্রয়ে ছিলো তারাই ওই সোনার গয়নাগাটি চুরি করেছে। এদিকে বাবা-মাকে হত্যা করার অভিযোগে রিমান্ডে থাকা ঐশী রহমানের বয়স পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু করেছে পুলিশ।