চুয়াডাঙ্গা মাতৃসদনে ভুমিষ্ঠ হওয়ার পর নবজাতক দত্তক দেয়ার পর প্রকৃত মা তুলে দেয় শিশু পাচারকারীদের হাতে?
সাইফ জাহান/খাইরুজ্জামান সেতু: ঈদের দিন প্রসব করা সেই নবজাতককে নিয়েই গত কয়েকদিন ধরে চলছে নানা নাটক। একজন দত্তক নিয়ে পুত্র নবজাতকের সাথে অন্যের কন্যা নবজাতককে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত শিশু চোরচক্র অপতৎপরতায় মেতে ওঠে। এক কমিশনারসহ পুলিশের এক দারোগা বিষয়টি নিয়ে ভিন্ন খেলা খেলতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি।
চুরি হওয়া নবজাতক দত্তক নেয়া মায়ের কোলে। আর ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনে ঢাকায় বিক্রির জন্য নেয়া দু নারী আকলিমা বেগম (৪৫) ও হাজেরা খাতুন (২৮) জেলহাজতে। গতপরশু এরাই নবজাতককে ঢাকায় নিয়ে বিক্রির অপতৎপরতা চালায়। কোচযাত্রী ও কোচের সচেতন যাত্রীদের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত এরা চুয়াডাঙ্গা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। গতকাল বুধবার দু নারীকে আদালতে সোপর্দ করা হলে বিজ্ঞ আদালত জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন। আকলিমা বেগম চুয়াডাঙ্গা হকপাড়ার আবুল কাশেমের স্ত্রী এবং হাজেরা খাতুন বর্তমান ঠিকানা হকপাড়ায় হলেও আলমডাঙ্গার পল্লি হাকিমপুরে। সে নয়নের স্ত্রী। দুজন ওই শিশুকন্যাকে তার মা শিউলী খাতুন বিউটির নিকট থেকে ২০ হাজার টাকায় কিনে ঢাকায় বিক্রির জন্য ঢাকায় নিচ্ছিলো বলে জানালেও শিশু কেনা-বেচার কথা সরাসরি স্বীকার করেনি। পুলিশি তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা রেলবস্তির বাসিন্দা শিউলী খাতুন বিউটি গত ঈদের দিন চুয়াডাঙ্গা মাতৃসদনে কন্যা সন্তান প্রসব করেন। তিনি জানান, তার স্বামী আমিরুল ইসলাম সন্ত্রাসী। একাধিক মামলায় কখনো পলিয়ে থাকে, কখনো পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। আমি কিডনি রোগে আক্রান্ত। এ সন্তানকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো। সন্তানকে মেরে ফেলা ছাড়া আমার কোনো রাস্তা নেই। এখান থেকে ওই সন্তান নিয়ে গেলে ফেলে দেয়া ছাড়া আমি ওকে বড় করবো কীভাবে? এ কথা শুনে মাতৃসদনেই চিকিৎসাধীন এক রোগীর মায়া জাগে। তিনি দু দিন আগেই মাতৃসদনে সিজার করে এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন। পুত্রের পাশাপাশি কন্যাসন্তানকে নিজের সন্তান হিসেবে বড় করে তোলার ইচ্ছে ব্যক্ত করেন। স্বামীকে বুঝিয়ে তিনি ওই শিশুকন্যার মায়ের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা দেন। একই সাথে কন্যাসন্তান দত্তক হিসেবে কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পুত্রসন্তান প্রসব করা মা ওই কন্যাকে নিয়ে নিজ বাড়ি চুয়াডাঙ্গা টিঅ্যান্ডটিপাড়ায় ফেরেন। নিজের বুকের দুধও খাওয়াতে থাকেন। একদিন পর তিনি মাতৃসদনে পুনঃসিজার দেখিয়ে কন্যা সন্তান হয়েছে বলে প্রচারও করতে থাকেন। এর চার দিনের মাথায় কন্যার প্রকৃত মা শিউলী খাতুন বিউটি দু মহিলাকে সাথে নিয়ে ওই দত্তক নেয়া মহিলার বাড়িতে হাজির হয়ে নিজের সন্তান ফেরত নিতে চায়। দত্তক নেয়া মা কন্যাকে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফিরে যায় শিউলী খাতুন বিউটি। সে আবার গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে টিঅ্যান্ডটিপাড়ার ওই বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। কান্নাকাটি শুরু করে। স্বামী তার সন্তানকে এক নজর দেখবে বলে আরজি করে। এ কথায় দত্তক নেয়া মা কন্যা নবজাতককে তার প্রকৃত মায়ের হাতে তুলে দেয়। প্রকৃত মা ২০ হাজার টাকার বিনিয়ে হকপাড়ার কাশেম আলীর স্ত্রী আকলিমা বেগম ও তার বাড়ি ভাড়াটে নয়ন আলীর স্ত্রী হাজেরা খাতুনের হাতে তুলে দেয়। আকলিমা ও হাজেরা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সযোগে ওইদিন দুপুরের কোচ ধরে ঢাকার পথে রওনা হয়। অপরদিকে দত্তক মা খুঁজতে শুরু করে। এক পর্যায়ে শিউলী খাতুন বিউটিকে পেলেও তার কোলে সন্তান না দেখে কান্নাকাটি শুরু করেন দত্তক মা। বিষয়টি জানাজানি হয়। এলাকার পৌর কাউন্সিলর পুলিশকে জানান। অপরদিকে ঢাকার ওই কোচের সুপারভাইজার কোচের মালিকের নিকট শিশু চুরির বিষয়টি জানিয়ে করণীয় জানতে চান। কোচের মালিকপক্ষ জানান, পুলিশকে। দত্তক মা চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার আব্দুর রহিম শাহ চৌধুরীকে জানিয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করেন। এসপি বিষয়টি দেখার জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর গাজী মোহাম্মদ ইব্র্রাহিমকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন। সদর থানার ওসি পরিবহনের ব্যবস্থা করে শহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আবুল খায়েরকে দ্রুত ঢাকার পথে রওনা হওয়ার জন্য বলেন। অপরদিকে কোচের ফিরতি কোচের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গায় ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া করা হয়। শেষ পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা ডিঙ্গেদহ থেকে নবজাতককে উদ্ধার এবং দু নারীকে গ্রেফতার দেখিয়ে এসআই আবুল খায়ের চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় সোপর্দ করেন।
পালিত মা বাদী হয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলায় দু নারী হাজেরা ও আকলিমাকে গতকাল আদালতে সোপর্দ করে। বিজ্ঞ আদালত জেলহাজতে প্রেরণের অদেশ দেন। মামলাটির তদন্তভার নিয়েছেন এসআই আবুল খায়ের। তিনি বলেছে, শিশুপাচারচক্রের দু নারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডে নেয়ার প্রক্রিয়া করা হচ্ছে। অপরদিকে কন্যার প্রকৃত মাসহ তার পিতাকেও খোঁজা হচ্ছে। বিষয়টিকে পুলিশ যথাযথ গুরুত্ব দিয়েই আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছে। আর নবজাতককে তার পালিত মা তথা মামলার বাদীর হেফাজতেই রাখা হয়েছে। পালিত মা তার পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করায় বিস্তারিত প্রকাশ করা হলো না।
অপরদিকে ঢাকায় নেয়ার পথে কোচযাত্রী ও কোচের সুপারভাইজারসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় ধরা পড়া দু নারী আকলিমা ও হাজেরা খাতুন অভিন্ন ভাষায় বলেছে, আমাদের এক আত্মীয় ঢাকায় থাকে। তার সন্তান নেই। তার নিকট দেয়ার জন্যই ওই নবজাতককে কিনে ঢাকায় নিচ্ছিলাম। পুলিশ বলেছে, এ কথার কোনো সত্যতা মিলছে না। বরঞ্চ শিশু বিক্রি ও পাচারচক্রের সন্ধান মিলতে শুরু করেছে।