স্টাফ রিপোর্টার: মারণনেশা ইয়াবা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। বিশেষ করে তরুণ ও শিক্ষার্থীরা এর নীল দংশনের শিকার হয়ে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিককালে দেশজুড়ে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেলেও টনক নড়ছিলো না সংশ্লিষ্টদের। তবে সম্প্রতি চামেলীবাগের নৃশংস জোড়া খুনের ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করলে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।
জানা গেছে, শীর্ষ প্রশাসন থেকে ইয়াবা প্রতিরোধে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা পেয়ে গতকাল সোমবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে এক জরুরি বৈঠকে ইয়াবা ঠেকাতে প্রশাসনিক ও সামাজিক সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ইয়াবার ভয়াবহ আগ্রাসনের কথা স্বীকার করে অধিদফতরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত ও আতঙ্কিত। শীর্ষ প্রশাসন থেকে গতকাল আমাদের এখানে নির্দেশনা এসেছে যে আর একটি ইয়াবাও যেন তরুণ সমাজ পেতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। সকলকে সর্বনাশা ইয়াবার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. ইকবাল বলেন, ওই নির্দেশনা পেয়ে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তা, এনজিও, মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান পরিচালকসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছি। বৈঠকে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক প্রতিরোধে প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনে গড়ে তোলার জন্য কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত শুক্রবার চামেলীবাগের বাসা থেকে পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ হত্যাকাণ্ডে নিহত দম্পতির মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামের ও লেভেলের ছাত্রী ঐশী রহমানের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। মূলত ইয়াবা আসক্তি থেকেই বন্ধুদের নিয়ে ১৭ বছরের এই কিশোরী নিজের মা-বাবাকে হত্যা করে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। যদি এটি তদন্তে প্রমাণিত হয়, তাহলে ঐশীর এ নিষ্ঠুরতার পেছনে ইয়াবা আসক্তিই কাজ করেছে বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানী, সমাজ বিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা মূলত নেশা জাতীয় একটি ট্যাবলেট। মেথঅ্যাম্ফিটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে এটি তৈরি করা হয়। কখনো কখনো হেরোইনও দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান একনায়ক হিটলার নাত্সী বাহিনীকে দিনের পর দিন নিদ্রাহীন, ক্ষুধা ও ক্লান্তিহীন এবং ক্ষিপ্র ও হিংস রাখতে এ ট্যাবলেট সেবন করতে বাধ্য করতেন বলে কথিত রয়েছে।
যুদ্ধ শেষে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার পর ইয়াবা আসক্ত সৈন্যরা এ ট্যাবলেট না পেয়ে অনেকে আত্মহত্যা করেন। একে অপরকে গুলি করে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। ইয়াবা মূলত থাই শব্দ, এর অর্থ পাগলা ওষুধ। ইয়াবা কোকেনের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ও উচ্চমাত্রার উত্তেজক মাদকদ্রব্য। এটি সাময়িক উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, ইয়াবা ব্যবহারে প্রথম দু তিন সপ্তা সামান্য ওজন কমলেও এরপর ওজন কমা বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে এটা ব্যবহারে মস্তিস্ক বিকৃতি, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ, যৌন ক্ষমতা হরাস, হাইপারটেনশন, হতাশা, বিষণ্ণতা ও আত্নহত্যার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। আসক্তরা ইয়াবা না পেলে অস্থির হয়ে ওঠে। অনেক সময় আত্মহত্যা ও খুন করতেও তারা দ্বিধা করে না। এ কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এটি নিষিদ্ধ। পরে এটি চলে যায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাতে। ইয়াবার প্রধান উত্পাদনকারী দেশ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার। বাংলাদেশ ইয়াবার বড় মার্কেট বলে জানা গেছে।
দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৫ লাখ! মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসূত্রে বলা হয়, ১৯৯০ সালে বছরে গড়ে ৪৫টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু এরপরের বছর ৫০ হাজার এবং ২০১২ সালে ২০ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। ১৯৯০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ অন্যান্য মাদকে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্যটি হলো, এদের ৮০ ভাগই তরুণ-তরুণী। এর পরের বছর আরেকটি সার্ভে করে অনুমানভিত্তিক মাদকাসক্তের সংখ্যা সাত লাখ বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী এলাকায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও কয়েকটি এনজিও সার্ভে করে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ১৫ লাখ বলে রিপোর্ট দেয়। ২০০৫ সাল থেকে এ সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যাই সর্বাধিক। যদিও জাতীয়ভাবে কোনো সার্ভে করা হয়নি। শুধু পকেট সার্ভে করেই মাদকের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখতে পান কর্মকর্তারা।
সূত্রমতে, ইয়াবা এখন রাজধানী থেকে শহর ও গ্রামাঞ্চলে চলে যাচ্ছে। অধিকাংশ গ্রামে ইয়াবা প্রকাশ্যে বেচাকেনা ও সেবন চলছে। সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ইয়াবা ব্যবহার হচ্ছে সর্বাধিক। ওইসব স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ইয়াবায় আসক্ত। সাধারণত ওইসব স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরাই পড়াশুনা করেন। তাদের অনেকেই পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি অনুযায়ী চলেন। এ কারণে ইয়াবা ব্যবহার তাদের অনেকের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া নামি-দামি মহিলা স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজসমূহেও ইয়াবায় আসক্তের সংখ্যা ব্যাপক বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ইয়াবার আগ্রাসন ও এর প্রতিরোধ প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, ইয়াবায় আসক্তরা এক পর্যায়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের আচরণে নিষ্ঠুরতা ও হিংস্রতার প্রকাশ পায়। ইয়াবার দীর্ঘ ব্যবহারে কিডনি লিভারসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক ইয়াবা আসক্ত শিক্ষিত তরুণ-তরুণী তার কাছে চিকিত্সার জন্য আসে। তিনি আরো বলেন, দেশব্যাপি ইয়াবার মারণ ছোবল থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ কোনো দলের নেতাকর্মীরাই নিরাপদ নন। তাই সময় থাকতে ইয়াবা প্রতিরোধে সকলকে এক সারিতে এসে সম্মিলিতভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট থেকেও এটি এখন বড় সমস্যা বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।