স্টাফ রিপোর্টার: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সরকার বিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণেরও প্রস্ততি নিচ্ছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। ৩০০ আসনের জন্য ইতোমধ্যে খসড়া প্রার্থী তালিকাও করা হয়েছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতেই হবে। বিএনপি আন্দোলনের সাথে সে কাজটিও করছে।
বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আগামী জানুয়ারিতে নির্বাচন করতে হবে- এমনটা মাথায় রেখেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের এলাকায় কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের মতে, নির্বাচনী গণসংযোগ এবং আন্দোলন এক সাথে চলবে। নইলে হঠাত করে সরকার বিরোধীদলের দাবি মেনে নির্বাচন দিয়ে দিলেও মাঠ গোছানো সম্ভব হবে না। সে জন্য আগে থেকেই নির্বাচনী এলাকাগুলোর মাঠ দখলে রাখতে চান তারা।
অক্টোবরের শুরুতেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একদফার আন্দোলনে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঈদুল আযহার কারণে সেপ্টেম্বরে সভা-সমাবেশ ছাড়া বড় কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি রাখছেন না তারা। তবে সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলন সফল করতে আগামী এক মাস তারা দেশব্যাপি ব্যাপক গণসংযোগ, বিভাগীয় পর্যায়ে জনসভা, সমমনা রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে তাদের দাবির পক্ষে আনতে কাজ করবেন। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী ভারতসহ গুরুত্বপূর্ণ দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছে এ দাবির যৌক্তিকতা আরও গ্রহণযোগ্যভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রোববার বর্তমান সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করার ঘোষণা দেয়ার প্রায় সাথে সাথেই তা নাকচ করে দিয়েছে বিএনপি। ইতোমধ্যে তারা স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবেন না। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল করেই তারা নির্বাচনে যেতে চান।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বর্তমান সংবিধানের বাইরে না যওয়ার প্রত্যয় ঘোষণার পর বিরোধী দলের সংসদের আগামী অধিবেশনে যোগদান অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। আগামী ১২ সেপ্টেম্বর সংসদের ১৯তম অধিবেশন বসছে। নবম জাতীয় সংসদের এটি শেষ অধিবেশন হতে পারে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা। ফলে সংবিধানে কোনো পরিবর্তন আনতে হলে ওই অধিবেশনেই করতে হবে।
বর্তমান সংবিধান অনুসারে জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। সে হিসেবে ২৫ অক্টোবর থেকে ২৫ জানুয়ারির মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা আশা করি জনগণের মতামতের দিকে শ্রদ্ধা রেখে আগামী সংসদ অধিবেশনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের বিল পাস করে সরকার শুভ বুদ্ধির পরিচয় দেবে। এরপরও তারা যদি একগুয়েমি ত্যাগ না করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে চায়, তাহলে রাজপথেই তার ফয়সালা হবে।
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আরও বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের একগুয়েমির কারণে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত দিয়েছে। তিনি বলেন, এ সরকারই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংকটের সৃষ্টি করেছে। তাই তাদেরকেই আবার দায়িত্ব নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে সংসদে কোন বিল আনবো না। তিনি বলেন, বিরোধীদল সংঘাত-সহিংসতা পছন্দ করে না বলেই বার বার সমঝোতার কথা বলছে।
সংসদে প্রস্তাব নয়: নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন সংসদে মুলতবি প্রস্তাবের নোটিস জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে শেষ মুহূর্তে তিনি ওই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন। একইভাবে আরও কয়েকজন সদস্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহালের দাবিতে সংসদে প্রস্তাব জমা দিলেও তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। সংসদের আসন্ন অধিবেশনেও যদি বিএনপি যোগ দেয়, তবু এ সংক্রান্ত কোনো আলোচনা বা মুলতবি প্রস্তাব জমা দেবে না বলে জানা গেছে।
বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, সরকারি দল সংসদে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কি করে তা দেখতে চায় বিএনপি। কারণ তারা সংসদে কোনো বেসরকারি বিল বা প্রস্তাব আনলেও সরকার না চাইলে তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যাবে। ফলে বিষয়টি সংসদ কর্তৃক নাকচ হয়ে গেছে বলে ইতিহাস হয়ে থাকবে। সরকারকে এ সুযোগ দিতে চায় না বিএনপি। এর বদলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক দফার দাবিতে তীব্র গণআন্দোলকেই তাদের জন্য সুবিধাজনক বলে মনে করছেন।
আন্দোলনের ধরন নিয়ে দু মত: সরকারবিরোধী আন্দোলনের ধরন নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে দু ধরনের মত রয়েছে। একপক্ষ মনে করেন, সরকার পতন ঘটিয়ে নির্বাচনে জিততে হলে টানা হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিতে হবে। রাজপথে শক্তি দেখাতে পারলে সরকার বেসামাল হবে, আর মাঠ চলে আসবে বিএনপির দখলে। ওই পর্যায়ে নির্বাচন হলে বিএনপির জয় কেউই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
অপরপক্ষের মত হলো, হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস আন্দোলন হঠাত করে শুরু হলে আবার ১/১১ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আর এতে করে বিএনপির লাভের চেয়ে লোকসান হবে বেশি। হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস আন্দোলন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সমর্থন পাওয়া যাবে না। বরং তারা মনে করেন, বর্তমানে মাঠের যে অবস্থা তাতে শতকরা ৮০ ভাগ স্বচ্ছ নির্বাচন হলেও বিএনপি জিতবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিলে এ সংকট সমাধান হবে। এখন তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিএনপিকে তারা কোন্ পথে ঠেলে দিতে চান। তিনি বলেন, নির্বাচন হলে বিএনপি যে জিতবে এটা এখন আওয়ামী লীগের কর্মীরাও মেনে নিয়েছে। তাই সরকার ভয় পেয়ে গেছে। তারা তাদের অধীনে নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী মুখে যতোই বলুন না কেন, আমরা বিশ্বাস করি দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে তিনি সমঝোতায় আসবেন। সরকারকে আমরা আরো কিছুটা সময় দিতে চাই। তা সত্ত্বেও সরকার যদি তত্ত্বাবধায়কের দাবি মেনে না নেয়, তাহলে শেষ যুদ্ধ হবে রাজপথে।
নির্বাচনের প্রস্তুতি: আন্দোলনের পাশাপাশি বিএনপি সাংগঠনিকভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ৩০০ আসনের জন্য ইতোমধ্যে খসড়া প্রার্থী তালিকাও করা হয়েছে। গত নির্বাচনে যেসব আসন জোটের প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিলো এবার সেসব আসনেও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা কাজ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। এবার ঈদে সম্ভাব্য অধিকাংশ মনোনয়নপ্রত্যাশী এলাকায় গিয়ে ঈদ করেছেন। ইফতারপার্টি হয়েছে দফায় দফায়।