অনুরাগে অনুভবে, প্রিয় মাতৃভাষা ……….. রেজাউল করিম খোকন ………..

সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবীতে কোনো ভাষা ছিলো না। ছিলো আদিম গুহামানবের কিছু অব্যক্ত অনুভূতি আর ইশারা, ইঙ্গিত। এরপর সময়ের ধারাবাহিকতায় মানুষের মুখে মুখে উদ্ভব হয়েছে ভাষার। ভাষার এই উদ্ভবের সাথে সাথে যাত্রা শুরু হয়েছিলো সভ্য মানুষের পদযাত্রাও। এ কারণেই মানবসভ্যতার সাথে ভাষার সম্পর্ক যেমন অবিচ্ছেদ্য, তেমনি ভাষার বিকাশের সাথে সাথে সভ্যতার আঙ্গিকেও এসেছে বহুমাত্রিকতা। শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত থেকে শুরু করে নাটক কিংবা সিনেমা, প্রযুক্তি কিংবা বিজ্ঞান-এমনি সভ্যতার প্রতিটি পদক্ষেপেই ভাষা আমাদের সামনে জ্ঞানকে উপস্থাপন করে বোধগম্য মাত্রায়। আর তাই মানুষ তার জন্মের লগ্ন থেকেই হয়ে পড়ে ভাষা নির্ভর। ভাষার মধ্যদিয়েই মানুষ চিনে নেয় তার পারিপার্শ্বিক সমাজ ও বিশ্বকে। যদিও যুগে যুগে সভ্য মানুষের এই ভাষা নির্ভরতার আদলে এসেছে ভিন্নতা। আর ভাষাগত এই ভিন্নতার ভিড়ে প্রতিটি মানুষই আদি ও অকৃত্রিমভাবে ভাষার যে রূপটিকে ভালোবেসেছে সেটি হলো তার মাতৃভাষা। জন্মগ্রহণের পর মায়ের মুখে শোনা ভাষাটাই গড়ে দেয় তার ভাষা নির্ভরতার প্রাথমিক বুনিয়াদ। এরপর কালক্রমে মানুষ নানা প্রয়োজনে, জ্ঞানার্জনের কারণে হয়তো অন্য ভাষাতেও হাতেখড়ি নেয়। তবে নতুন করে শেখা সেই ভাষার মানে বুঝতে তাকে আবারও দ্বারস্থ হতে হয় মাতৃভাষার। ভাষার প্রতি আমাদের যে অফুরন্ত ভালোবাসা হূদয়ে লালন করি, চেতনার জগত্ কিংবা অবচেতনে যা আমাদের আলোড়িত করে বার বার সেই ভাষা কেবলই আমার মায়ের ভাষা, মাতৃভাষা।
এই পৃথিবীতে সবার মাঝে যেমন আমার মা-ই সেরা তেমনি বিশ্বের অসংখ্য ভাষার ভিড়ে প্রতিটি মানুষের কাছে প্রিয় ভাষা হলো তার মাতৃভাষা। আর মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার বোধ যাদের মধ্যে অনুপস্থিত তারা অনেকটা মাতৃহীন শিশুর মতোই। বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডে আমাদের বসবাস, আমাদের সবার প্রিয় ভালোবাসার মাতৃভাষাটি হলো বাংলা। তাছাড়া বাংলা ভাষা শুধু আমাদের ভালোবাসারই আশ্রয় নয়, বরং এ ভাষা আমাদের পরম গৌরবেরও। মানবসভ্যতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য এমন কোনো জাতিসত্তা নেই যারা নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেছে। কিন্তু আমরা আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ে বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছি। আমরা সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি প্রাণের বিনিময়ে। ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য আমাদের এই আত্মত্যাগ তাই স্বীকৃতি লাভ করেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের চিরায়িত যে ভালোবাসা সেই ভালোবাসার মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে আমাদের ভাষা আন্দোলনের মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আদলে পরিচিতি পেয়েছে গোটা বিশ্বে। ভাষা আন্দোলনের গৌরবে গর্বিত আমাদের বাংলা ভাষা যেমন ঐতিহাসিকভাবে একটি দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছে তেমনি বহু বিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে এর আঙ্গিক ও বিন্যাসেও। বাংলা এখন ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের জীবনাচরণের প্রতিটি পদক্ষেপেই, শিল্প-সাহিত্যের আঙ্গিক থেকে প্রযুক্তির বিস্তৃত পরিসরে বাংলাভাষা তৈরি করেছে তার সরব উপস্থিতি। নানা আঙ্গিকে আমাদের প্রিয় বাংলাভাষা ক্রমেই এগিয়ে চলেছে। বেড়েছে আকাশ সংস্কৃতিতে বাংলা ভাষার প্রতিনিধিত্বও। তবে সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন আজও সম্ভব হয়নি বিভিন্ন কারণে। এটা আমাদের এক ধরনের ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে। একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির গুরুত্বকে আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করি না। ইংরেজির প্রতি আমাদের বিদ্বেষ না থাকলেও যেসব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে অনায়াসেই কাজ চালিয়ে নেয়া যায় সেখানে ইংরেজি ভাষাকে অনাবশ্যক টেনে আনা আমাদের দীনতারই বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। এদিকে আমাদের আধুনিক সমাজ ও সংস্কৃতিতে বাংলাভাষার সাথে অন্য ভাষার সংমিশ্রণ বা বিকৃত উচ্চারণে বাংলা বলার বিষয়টিও ইদানীং আমাদের ভাষার গৌরব ও মর্যাদাকে অনেকটাই ম্লান করে দিচ্ছে। এ ধরনের প্রবণতা অবশ্যই নিন্দনীয়। আজকাল কেউ কেউ তথাকথিত স্মার্টনেসের প্রকাশ ঘটাতে বাংলার সাথে অনাবশ্যক ইংরেজির মিশেল ঘটাচ্ছেন, অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলছেন। এ ধরনের দীনতা হীনতা আমাদের জাতিসত্তাকে ম্লান করে দেয়, বাংলা ভাষার গৌরব, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধকে আঘাত করে। এ বিষয়ে আমাদের সবার সচেতনতা প্রয়োজন। প্রিয় মাতৃভাষার অমর্যাদা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।