সড়কে যাত্রীসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবে স্থায়ী সমাধান দরকার

 

শুধু চুয়াডাঙ্গায় নয়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান। অবৈধ যানের অবাধ চলাচল। শ্যালোইঞ্জিনচালিত হরেক নামের অবৈধ যানের বৈধতা না থাকলেও সড়কে চলছে বেপরোয়াভাবে। অপরদিকে বৈধ যানবাহনের ফিটনেস-রুটপারমিট নিয়ে অভিজ্ঞমহলের প্রশ্ন থাকলেও মাত্রারিক্ত কালো ধোঁয়াযুক্ত নড়বড়ে মুড়ির ঢমেরও সড়কে চলাচলের অনুমোদন মেলে হরহামেশায়। বিদ্যুতে পুনঃশক্তি সঞ্চিত ব্যাটারিচালিত তিন চাকার গাড়ি বিদেশ থেকে আমদানির অনুমোদন মিললেও সড়কে চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে বিশৃঙ্খলার মাত্রা বহুগুনে বাড়িয়েছে। এরই কুফল ভোগ করতে হচ্ছে চুয়াডাঙ্গার যাত্রীসাধারণকে। গতপরশু দুপুর থেকে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর এবং গতকাল সকাল থেকে চুয়াডাঙ্গার সকল সড়কে বাস যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কারণ, পাল্টাপাল্টি ধর্মঘট। পরশু রাতে ইজিবাইক মালিক-শ্রমিক বহুমুখী সমবায় সমিতির আহুত ধর্মঘটের পর গতকাল চুয়াডাঙ্গা আন্তঃজেলা বাস-ট্রাক সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট আহ্বানে সড়ক চলাচল ব্যবস্থায় চরম অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। দুর্ভোগ পোয়াতে হয় যাত্রীসাধারণকে। এ দুর্ভোগের দায় কার?

বাস-ট্রাক মালিকদের দাবি-তারা অনেক টাকা শুল্ক পরিশোধিত বাস-ট্রাক চড়া মূল্যে কিনে আয়ের আশায় সড়কে ছাড়েন। সড়কে চলতে গিয়ে প্রতিবছর আয়করসহ সড়ক শুল্ক গুনতে হয়। এরপর যদি অবৈধ যানের কারণে যাত্রী বা মালামাল বহনের মাশুল আয় হ্রাস পায় তা হলে বাস মালিকেরা নীরব থাকবেন কেন? থাকে না, মাঝে মাঝেই সরব হন তারা। বাস-ট্রাক শ্রমিক-মালিক ঐক্য পরিষদের আহ্বানে মাঝে মাঝেই ধর্মঘট শুরু হয়। প্রধান প্রধান সড়ক থেকে অবৈধ যান উচ্ছেদের নামে গুটিকয়েক অবৈধ যান আটক এবং ছাড়ার মধ্যে সেই ধর্মঘট স্থগিত হয়। এ ছবি চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে অচেনা নয়। এর সাথে সংযুক্ত হয়েছে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার ইজিবাইক বা অটোরিকশা নিয়ে সমস্যা। ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার ছোটগাড়ি নিয়েও কিছুদিন আগে চরম বিশৃঙ্খলা চিত্র এলাকাবাসীর সামনে উঠে আসে। সেটা নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার কিছুটা নিষ্পত্তি হতে না হতে ব্যাটারিচালিত তিন চাকার রিকশা নিয়ে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছেছে। ইজিবাইক মালিক-শ্রমিক সমিতির দাবি, তারা তো ওই অটোরিকশা বিদেশ থেকে চুরি করে আনেননি। কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য হ্রাসকৃত শুল্কে আমদানি করা শ্যালোইঞ্জিন দিয়েও এ যানবাহন তৈরি করেনি। তা হলে সড়কে মুক্তভাবে চলাচল করতে পারবে না কেন? শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধ যান চলবে আর দোকান থেকে বৈধভাবে বেচাকেনা করা ইজিবাইক চলাচলে পরিবহন মালিকরা তাদের শ্রমিক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে? এটা হতে দেয়া যাবে না। বৈধভাবে চালানোর সনদ ও সুযোগ দিতে হবে। এ দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে ইজিবাইক মালিক শ্রমিকেরা আন্দোলন করে আসছে। এরই মাঝে একটি ইজিবাইক ভাঙচুরের জের ধরে কয়েকটি বাস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর নতুন করে ত্রিমুখি সংঘর্ষ বাধে। এতে সদর থানার ওসিসহ বেশ কিছু শ্রমিক আহত হন। এ ঘটনারই জের ধরে চলছে ধর্মঘট। দুর্ভোগের বোঝা বইতে হচ্ছে আমজনতাকে।

অবশ্যই কর্মসংস্থান সংকটের সমাজে অবৈধযান চালিয়ে অসংখ্য মানুষ তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়েছে। সচ্ছলতা আনতে গিয়ে তারা পরিবেশ দূষণই শুধু নয়, সমাজে পঙ্গুত্বের ভয়াবহ অভিশাপের বোঝা চাপিয়ে চলেছেন। পরিচ্ছন্ন পরিসংখ্যান না থাকলেও, প্রতিদিন অবৈধ যানগুলোর দৌরাত্ম্যে তথা দুর্ঘটনায় হতাহতের চিত্র হাসপাতালগুলোর দিকে তাকালে অনুমান করা যায়। সে হিসেবে বলা যায়, যতোগুলো পরিবারে সচ্ছলতা ফিরেছে তার চেয়ে ঢের বেশি পরিবারে পঙ্গু নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরের সংখ্যা বেড়েছে। এরপরও অবৈধযান সড়ক থেকে উচ্ছেদে প্রশাসনের নমনীয়তা কেন? মানবতা নাকি রাজনৈতিক তদবিরের অজুহাত? এটা ঠিক যে, অবৈধযানের সংখ্যা এতোটাই বেড়েছে যে, এখন তা বন্ধ করা অমানবিকও। এ কারণেই মূলত প্রধান প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে গ্রামের উপসড়কগুলোতে চালানোকে নমনীয় দৃষ্টিতে দেখার পক্ষে প্রায় সকলে। বাস-মালিক শ্রমিকদেরও তাতে সাই রয়েছে। এ সাইয়ের ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গা জেলা আইনশৃঙ্খলা বৈঠকেও সেরকমই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাস্তবায়নে ত্রু টি তো রয়েছেই। তা না হলে উচ্চাদালতের আদেশের পরেও প্রধান প্রধান সড়কে অবৈধযানের অবাধ চলাচল দৃষ্টিগোচর হয় কীভাবে?

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা ইজিবাইক চলাচলে পৌর এলাকার বাইরের সড়কে প্রতিবন্ধকতার মূল কারণ, বাসের যাত্রীমাশুল হ্রাস। বাস-মালিকদের আয়কর, রুটপারমিট ও পরিবহন চলাচলের উপযোগিতা অনুমোদন নিতে বছরান্তে যে হারে, যে পরিমাণে টাকা গুনতে হয় তাতে তাদের আয়ের বিষয়টিকেও খাটো করে দেখা ঠিক হবে না। যদিও অন্য যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতার চেয়ে সেবাদানের মধ্য দিয়ে আয় বৃদ্ধির প্রতিযোগিতাই গ্রহণযোগ্য। কারণ প্রতিযোগিতার যুগে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতায় টেকার উপায় না খুঁজে পেশিশক্তি প্রয়োগে স্বার্থ আদায় খুব বেশি স্থায়ী হয় না। হবে না। সড়ক থেকে অবৈধযান উচ্ছেদ করতে হবে। শহর ও প্রধান প্রধান সড়কগুলো নিরাপদ করতে ট্রাফিক আইন মেনে চলার বিষয়টি সকলকেই ভাবতে হবে। ট্রাফিক আইন মেনে না চলার কারণে সড়ক যে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। সড়ক নিরাপদ করতে, সড়কের বিশৃঙ্খলা রোধে অবশ্যই আইনের যথাযথ প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহের আন্তরিকতার বিকল্প নেই। আন্তরিকতা হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত। যা কিছু সমাজের জন্য ক্ষতিকর তা দয়ার দৃষ্টিতে দেখে আইন প্রয়োগে নমনীয়তা কাম্য নয়। কারণ প্রশাসনের সেই নমনীয়তার খেসারত সমাজকেই দিতে হয়। যেমনটি শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধ যানের খেসারত সমাজকেই দিতে হচ্ছে। প্রকশ্যে দেদারছে তৈরি হচ্ছে অবৈধ যান। সেদিকে নজর নেই। এ ছাড়া দেশে বিদ্যুত আছে কি-না, বিদ্যুতে চার্জ দিতে গেলে বিদ্যুতের মান ধরে রাখা যাবে কি-না তা না দেখে আমদানির অনুমোদন দেয়া হলো কেন? আমদানির পর ভুল হয়েছে বলে নতুন করে তা নিষিদ্ধ করা হলেও ভুল করা ওই কর্তার বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? যারা দোকান থেকে কিনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে? তা না দিয়ে সড়কে নিষিদ্ধ করার যুক্তি কতোটা যুক্তিযুক্ত? এ বিষয়ে বলতেই হয়, যে যানবাহন বিদেশ থেকে আমদানির অনুমোদন দেয়া হলো তা সড়কে বৈধভাবে চালানোর অনুমোদন না দিয়ে ছলচাতুরি সরকারের নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতারই বহির্প্রকাশ। জবাবদিহিতার অভাবে কর্তাদের দূরদৃষ্টিতে ছানি পড়েছে। চিকিৎসা দরকার বটে।

সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় অচলাবস্থা দীর্ঘাস্থায়ী হলে তার কুপ্রভাব পড়বে বাজারসহ সর্বক্ষেত্রে। অবশ্য অচলাবস্থা নিরসনে শুধু প্রশাসনের একক উদ্যোগ নয়, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদেরও আন্তরিক হতে হয়। অটো কিনলেই তা সড়কে চালানোর জন্য বৈধ হয় না, বৈধতার জন্য অনুমোদন নিতে হয়, চালককেও নিতে হয় চালক হিসেবে স্বীকৃতিপত্র। চুয়াডাঙ্গায় যারা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালান তাদের ক’জনের চালক হিসেবে স্বীকৃতিপত্র আছে? খুঁজে পাওয়া ভার। ছোট বড় সড়কে শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধ যানের চালকদের বেপরোয়া গতি এবং রাতে চলাচলের জন্য লাইটের যে হাল তা দেখে সমাজে প্রশাসন আছে বলে মনে হয় কি? সড়কে বিশৃঙ্খলা নয়, সড়ক নিরাপদ করতে হবে। দফায় দফায় যাত্রীসাধারণের হয়রানি বন্ধে স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। যেহেতু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার সিংহভাগই চলে গেছে বেসরকারি সংস্থাসমূহের হাতে, সেহেতু সমঝোতার পথে হাঁটাই হবে দুর্ভোগ হ্রাসের সহজ উপায়। প্রশাসন যতো দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে ততোই কল্যাণ। গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গার সকল সড়কে পরিবহন ধর্মঘট চলছিলো। প্রশাসনের তরফে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের চেষ্টা চলছিলো। উভয়পক্ষ অনমনীয়। ফলে জিইয়ে রয়েছে সংকট।