শিক্ষাজীবনে পরীক্ষার বিড়ম্বনা

 

শিক্ষার সাথে উন্নতির গ্রাফ সরাসরি জড়িত। অর্থাৎ বিশ্বে যে দেশ যতো বেশি শিক্ষিত, তারা ততো বেশি উন্নত। আমরাও যতোটা উন্নতির সোপান অতিক্রম করেছি এবং করছি- তার প্রধান অনুঘটক আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। কিন্তু শিক্ষা মানে কি হাতেগোনা কিছু পাঠ্যবইয়ের পাঠ এবং তা যাচাইয়ের নিশ্ছিদ্র পরীক্ষা ব্যবস্থা? নানাবিধ সংস্কার শেষে আমাদের দেশে চলমান শিক্ষাব্যবস্থা এখন পুরোটাই পরীক্ষা কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করতেই একজন শিক্ষার্থীর চারটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। আর প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রতিটি শ্রেণিতে অংশ নিতে হয় কমপক্ষে ছয়টি পর্বের আভ্যন্তরীণ পরীক্ষায়। একটি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই আরেকটি পরীক্ষার সূচির কাছে নিঃশ্বাস ফেলে।

 

পরীক্ষার বোঝা একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভীত ও যান্ত্রিকই করে তোলে না, রিডিং ফর প্লেজার বলে ইংরেজিতে যে আপ্তবাক্য রয়েছে- তা বিঘ্নিত হয় মারাত্মকভাবে। আর আনন্দের সাথে পড়ালেখা করতে না পারলে তা হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের তোতাকাহিনী গল্পের মতো। সেই গল্পে একটি মূর্খ তোতাপাখিকে শিক্ষিত করতে পুস্তকের পাতা বার বার জোরপূর্বক গেলানো হয়, অতঃপর মৃত্যু ঘটে তার। বিদ্যা তখন সেই মৃত তোতার পেটের মধ্যে গজগজ খসখস করতে থাকে। মারা গেলেও তোতা যে অবশেষে শিক্ষিত হলো- তা ভেবেই পণ্ডিতরা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। প্রতীকী তোতাকাহিনীর সাথে আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ব্যবস্থার খুব বেশি হেরফের আছে কি? পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হতেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় একজন শিশু শিক্ষার্থীকে। এ পরীক্ষায় পাস করা বা ভালো ফল করার প্রস্তুতি শুরু হয় বছরের শুরুতেই। মূল ক্লাস বাদ দিয়ে স্কুলগুলোতে শুরু হয় কোচিঙের নামে বাড়তি পড়াশোনা। কথিত মডেল টেস্ট তখন পড়াশোনার ধার পরীক্ষার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে ওঠে। এরপর তিন বছর পার করতেই অংশ নিতে হচ্ছে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায়। পুনরায় শুরু হয় পঞ্চম শ্রেণির আদলেই কোচিং-পরীক্ষা। স্কুলের কৃতীত্ব বৃদ্ধি করা ও বাড়ানোর দায়ভার পড়ে শিক্ষার্থীর ওপর। এর মাত্র দু বছর পর এসএসসি এবং এর আরও দু বছর পর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এভাবে চারটি পাবলিক পরীক্ষা ছাড়াও স্কুলের আভ্যন্তরীণ পরীক্ষার চাপে দিশেহারা শিক্ষার্থীরা। স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষার লেজ ধরে পুনরায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং যখন-তখন নতুন বিষয়ের চাপে শিক্ষা নিয়ে শিশুদের শৈশব বিপন্ন হয়ে পড়ছে মানসিক চাপে।

 

শিশুদের জন্য পরীক্ষার এ বিভীষিকা চলতে থাকলে তা আখেরে আমাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। সৃজনশীলতা ও আনন্দ রুদ্ধ হয়ে যাবে পরীক্ষামুখি লেখাপড়ার কারণে। সুতরাং শিক্ষা নিয়ে এ মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কোমলমতি শিশুদের ওপর চাপ কমাতে পরীক্ষা ও পাঠ্যবইয়ের বোঝা কমাতে হবে। তা না হলে একটি প্রজন্মের শিশুরা বড় হবে মানসিক ভীতির মধ্যদিয়ে, যন্ত্রের মতো করে। আর এরূপ শিক্ষাপ্রণালীতে শিশু-কিশোরদের মন অপরিণত থেকে যাবে, অসম্পূর্ণ থাকবে বুদ্ধির বিকাশ।