শাহজাহান ভাই আমার অনুভবে- আ.স.ম.আবদুর রব

মোহাম্মদ শাহজাহান অত্যন্ত প্রতিভাবান, দুরদর্শী ও সুতীক্ষ্ম চিন্তার অধিকারী একজন মানুষ। উনার সঙ্গে আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে, যখন তিনি পরিণত বয়সের। আমি শুনেছি, উনি উনার বাবার সঙ্গে একই নাটকে অভিনয় করতেন। তখনকার দিনে ‘সিরাজ-উদ-দৌলা’ নাটকে অভিনয় করে মঞ্চ কাঁপানো- তখন তো ঢাকাতেই থিয়েটার হয়নি, চুয়াডাঙ্গার মতো জায়গায় নাটক মঞ্চস্থ করা কি চাট্টিখানি কথা!

ষাটের দশকে শাহজাহান ভাইয়ের আড্ডা ছিল বাংলাদেশের সব নামকরা কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে। কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক ছিল। মনে পড়ে, শাহজাহান ভাই একবার আমাকে কবি সিকান্দার আবু জাফর-এর বাড়িতে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি চিত্রকলা, সাহিত্য, নাট্যাঙ্গন ও বাংলা একাডেমী-কেন্দ্রিক নানা কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। আহমদ ছফাকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করতেন। মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরী সবার সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল। রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গেও কথা হতো। কবি আল মাহমুদ, হাশেম খান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আনিসুজ্জামান খান; কাকে রেখে কার নাম বলব?

ঢাকায় যখন প্রথম রেডিও স্টেশন হয়, তখন রেডিও-কেন্দ্রিক আড্ডায় নিয়মিত হাজির থাকতেন। ইংরেজি পত্রিকা/ম্যাগাজিন বেশি পড়তেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন শ্রমিক-শ্রেণির সঙ্গে বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে, তাদের মঙ্গল কামনা করে। আবার সমাজের উঁচুস্তরের মানুষের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। কখন কোথায় থাকতেন, কী করতেন, কী খেতেন- ঠিক নেই। আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম ভাইকে আপন ভাইয়ের মতো মানতেন। ময়মনসিংহের মোশারফ হোসেনও শাহজাহান ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি কারো পকেট হাতড়াতেন না, কিন্তু উনার বিচক্ষণতায়, শিল্প-সাহিত্যের বৈঠকী আলোচনায় যাঁরা মুগ্ধ, তাঁদের ক’জন তাকে আড়ালে আবডালে নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। শাহজাহান ভাই দামি বই সংগ্রহ করতেন। দামি সিগারেট ফুঁকতেন। হাতে সব সময় কোনো না কোনো বই থাকতো। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন দলীয় সভা-সমাবেশে এমন কিছু উদ্ধৃত করতেন, সেগুলো শুনে আমরা তাজ্জব হয়ে যেতাম।

শাহজাহান ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় সম্ভবত ১৯৭০ সালে। আমি তখন ডাকসু’র ভিপি। একদিন সকাল বেলা একটা লোক আমার দরজায় এসে কড়া নাড়লেন। লোকটা সিরাজুল আলম খান দাদাভাইকে খুঁজছেন। দাদাভাইয়ের সন্ধানে আমার কাছে আগমন। আমি পরিচয় জানতে চাওয়ায় বললেন, আমি শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করি; নাম মোহাম্মদ শাহজাহান। আগে থেকেই তাঁর নামের সঙ্গে পরিচয় ছিল। এই প্রথম দেখলাম। চেহারার দিকে তাকালেই সমীহ করতে ইচ্ছে জাগে। পরিচয় পেয়ে বসতে বললাম। উনাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। উনি বললেন, গতরাতে পোস্তগোলায় শ্রমিকদের আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। এ নিয়ে তুমুল উত্তেজনা। দাদা ভাই কোথায়? এ ব্যাপারে উনার সঙ্গে পরামর্শ করে করণীয় ঠিক করতে হবে।

জানা গেল, শ্রমিকদের লাশ পড়ে আছে মর্গে। আমি তৎক্ষণাৎ সকল ছাত্রনেতাকে একত্রিত করলাম। সবাই মিলে মর্গে গেলাম। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে লাশ বের করে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নিয়ে এলাম। তাৎক্ষণিকভাবে পরদিন হরতালের কর্মসূচি ঘোষিত হলো। স্লোগান দিলাম। পুলিশ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যখন চাংখারপুল মোড় পার হয়ে গুলিস্তান মোড় অবধি পৌঁছে গেছি, মিছিলের লোক তখন হাজার পেরিয়ে গেল। সেই ঢেউ সদরঘাট, মতিঝিল বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ল। পরদিন হরতাল সফল করতে চারদিকে লোক পাঠানো হলো।

আমি শাহজাহান ভাইকে বললাম, আপনি পোস্তগোলায় গেলে এ্যারেস্ট হয়ে যেতে পারেন। আমার সঙ্গে হলে চলুন। ইতোমধ্যে দাদা উঠেছেন। ইকবাল হলের টেনিস লন-এ দাদা, কাজী আরেফ আহমেদ, শাহজাহান ভাইসহ কয়েকজন পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনায় বসলাম। আমাদের রাজনৈতিক নেতা মান্নান সাহেবকে দিয়ে হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করার জন্য খবর পাঠালেন। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ‘লিডার’ অন্য কোনো জটিলতা চান না।

আমি বললাম, ডাকসুর ভিপি হিসেবে আমি যে কর্মসূচি ঘোষণা করে ফেলেছি, সেখান থেকে সরে আসতে পারবো না। এহেন পরিস্থিতিতে শাহজাহান ভাই খানিকটা বিচলিত হলেন- কী হবে? যাহোক, পরদিন শান্তিপূর্ণভাবেই হরতাল পালিত হলো। সেই থেকে আমি আর শাহজাহান ভাই এক সঙ্গে কাজ করতে লাগলাম। যখনকার কথা বলছি, তখন কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া তেমন কোনো শক্তিশালী সংগঠন ছিল না। শ্রমিকদের সংগঠিত করা দরকার- নইলে আওয়ামী লীগের ছায়াতলে সমবেত করা যাবে না। সেই লক্ষ্য নিয়েই সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই মোহাম্মদ শাহজাহানকে খুঁজে বের করেছিলেন। বামপন্থীদের সমান্তরালে শ্রমিক সংগঠন দাঁড় করানো চাট্টিখানি কথা নয়।

আমি দাদার কাছ থেকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ যত সহজে বুঝতাম, তার চেয়ে সহজে বোঝাতে পারতেন শাহজাহান ভাই। হয়ত দাদাকে সব প্রশ্ন করতামও না। কিন্তু শাহজাহান ভাই ছিলেন খোলা মনের মানুষ। সব বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা যেত। বয়সে তিনি আমার চেয়ে অনেক বড় হলেও ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। জাসদে উনাকে উপযুক্ত মূল্যায়ন করার জন্য পদ সৃষ্টি করা হলো- ‘অধ্যক্ষ’। এটা আগে পরে আর কারো জন্য প্রযোজ্য হয়নি। এটা হয়েছিল দাদা’র নির্দেশ/সুপারিশে (রিকমেন্ডেশন)।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমান আর মোহাম্মদ শাহজাহান পরস্পর খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। আলোচনার উপযুক্ত বিষয় পেলে দু’জনে তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকতেন। শাহজাহান ভাই লেখালেখি যে খুব বেশি করতেন তা নয়, কখনো সখনো শর্টহ্যান্ড-এর মতো নোট নিতেন। শুধু আড্ডা-আলোচনায় বসলে বোঝা যেত তাঁর চিন্তার গভীরতা। শাহজাহান ভাই যখন জাসদের সভাপতি হলেন, আমি তখন সাধারণ সম্পাদক। আমাদের পরস্পরের মধ্যে এত বেশি আস্থা ও বিশ্বাস ছিল যা কল্পনার বাইরে। আমার সঙ্গে আলোচনা না করে সাংগঠনিক বিষয়ে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না। এমনকি দাদার সঙ্গে কথা বলার আগে আমার মতামত জেনে নিতেন।

মোহাম্মদ শাহজাহান ছিলেন আপোষহীন নেতা। সকল বাম, ডান দলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক ছিল। তাঁর মতো এত বিচক্ষণ নেতা আর কোনো দলে ছিল কিনা সন্দেহ। দুর্ভাগ্য যে, আমরা তার উপযুক্ত মূল্যায়ন করতে পারিনি। আমার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক পরামর্শের ব্যাপারে শাহজাহান ভাইয়ের মতো আস্থাযোগ্য আর কাউকেই পাইনি। যখন জেলখানায় ছিলাম, তখনো তাঁর সঙ্গে চিরকুটের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল।

নিজের প্রতি শাহজাহান ভাইয়ের যথেষ্ট অবহেলা ছিল। শ্রমিক স্বার্থ দেখতে গিয়ে জীবনের প্রতি অবিচার করেছেন। নিজের জন্য ন্যূনতম যেটুকু দরকার, সেদিকেও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। অর্থাভাবে কখনো সিগারেট অর্ধেক করে খেতেন। নিজেকে উৎসর্গ করার রাজনীতি করতেন। আন্তর্জাতিক ও উপমহাদেশীয় রাজনীতি সম্পর্কে এত স্পষ্ট ও অগাধ জ্ঞান রাখতেন যে আমরা বিস্মিত হয়ে যেতাম। উনার অনুপস্থিতিতে আমি অন্তত এতিম হয়ে গেছি। উনার অভাববোধ আমার কাছে তীব্র। কারণ দাদা ভাই ছাড়া আমাকে বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়ার কেউ রইল না। মুক্তিযুদ্ধ শাহজাহান ভাইয়ের যে অসামান্য অবদান রয়েছে সে কথা কালের অতলে চাপা পড়ে যাচ্ছে। তিনি জনমত গঠনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের পাসপোর্টে সমগ্র বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে বাংলাদেশ মুজিব ফোর্স (বিএলএফ)-এর জন্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। সেক্টর কমান্ডারা যেসব ওয়াকিটকি ব্যবহার করতেন, সেগুলোসহ বিভিন্ন যুদ্ধ-সামগ্রী যোগাড় করার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান অনেকেরই অজানা।

শাহজাহান ভাই ১৯৮৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন আমাকে বিরোধী দলীয় নেতা নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। সংসদে রেফারেন্স ছাড়া কখনো কথা বলেননি। ফলে স্পিকার কখনো তাঁর মাইক বন্ধ করেছেন বলে মনে পড়ে না। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর আদর্শিক রাজনীতিকে নেতা-কর্মীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে মোহাম্মদ শাহাজাহানের বিশেষ অবদান রয়েছে। যখন যে প্রয়োজনে তাঁকে ডাকা হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে হাজির। রাজনীতিই উনার সংসার, রাজনীতিই জীবন। তাঁর জন্মই হয়েছিল গরিব মানুষের ভাগ্য বদলের জন্য। অপূর্ব মানবিক গুণের অধিকারী শাহজাহান ভাইকে কখনো উত্তেজিত হতে দেখিনি। সবার সঙ্গে সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলতেন। বক্তৃতার মঞ্চে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতেন- সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনত। সবচেয়ে বড় কথা, শ্রমিকরা উনার কথা বুঝত, উনি শ্রমিকদের ভাষা বুঝতেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে উপজেলা ব্যবস্থা বিদ্যমান, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ তথা জনগণের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এরশাদ সাহেবের হাতে যার বাস্তবায়ন, অনেকেই জানেন না- এই প্রস্তাবনা জাসদের। দলের হয়ে মোহাম্মদ শাহজাহান ভাই বঙ্গভবনে এরশাদসহ সামরিক বাহিনীর তৎকালীন সকল সিনিয়র অফিসারদের উপস্থিতিতে দীর্ঘ দুই ঘণ্টার বক্তব্য পেশ করে উপজেলা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ও এর উপকারিতা ব্যাখ্যা করেন। তাঁর সেই চিন্তা ও পরিশ্রমের ফসল আজকের প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও উপজেলা ব্যবস্থা। (অনুলিখন : রাজিব আহমেদ)