লোক দেখানো জাকাত প্রদান এবং দারিদ্র্য

 

শুক্রবার ভোরবেলা। স্থান ময়মনসিংহ শহরের অতুল চক্রবর্তী সড়কের একটি বাড়ি। ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু ফটক। সেই ফটক খুলে দেয়া হলো জাকাতপ্রার্থীদের জন্য। আর বাঁধভাঙা স্রোতের মতো মানুষ সেখানে ঢুকে পড়লো। কিছুক্ষণ আগেও যারা ছিলেন জীবন্ত মানুষ, মুহূর্তে তারা হয়ে গেলেন লাশ। মানুষের পদতলে পিষ্ট হয়ে একটি-দুটি নয় ২৭ জন নারী ও শিশু মুহূর্তে লাশ হয়ে গেলেন। আভিযোগ রয়েছে টোকেন দিয়ে মাইকিং করে নারী-পুরুষ শিশুদের জড়ো করা হয়। ভিড় সামলাতে গিয়ে লাঠিপেটায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়। মর্মান্তিক। ন্যায় বিচার কাম্য।

জাকাত নিতে গিয়ে নিহতদের মধ্যে দু বছরের শিশু যেমন আছে, তেমনি আছেন ৭৫ বছরের বৃদ্ধাও। এ ঘটনার পরও কি নিজেদের সভ্য বলে দাবি করা যায়? লোক দেখানো জাকাত প্রদান, না সভ্যতা, না ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ। অথচ আমরা অনেকেই মানবতার সাচ্চা সেবক বলে অনেক সময়ই বড়াই করি। দরিদ্রদের লাইনে দাঁড় করিয়ে জাকাত দেয়া নাকি তামাশা করা? এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে কেবল পদদলনে নারী-শিশুদের প্রাণই ঝরছে না, পদদলিত হয়ে নিষ্পেষিত হচ্ছে মানবতাও। জাকাত ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। ধনীরা তাদের অর্জিত সম্পদের একটি অংশ গরিবকে দেবেন, সেটাই ইসলামের বিধান। কিন্তু এভাবে মাইকে ঘোষণা দিয়ে, কার্ড বিলি করে, মহা শোরগোল তুলে জাকাতের শাড়ি দেয়ার কি যুক্তি থাকতে পারে?

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ময়মনসিংহের একটি জর্দ্দা কারখানার মালিক শামীম তালুকদার প্রতি বছর জাকাতের শাড়ি বিলি করেন। এবারও জাকাতের শাড়ি বিলি করার জন্য কার্ড বিলি করেছেন। লোকমুখে শুনে সেই কার্ড পাওয়া লোকদের পাশাপাশি কার্ড না পাওয়া নারী-পুরুষও ভিড় জমিয়েছিলেন। ছোট্ট গেট। অনেক মানুষ। কিন্তু তাদের সামাল দিতে কোনো ব্যবস্থা রাখেননি তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ডাকার প্রয়োজনও বোধ করেননি। অভিযোগ রয়েছে, তার বাসার দু নিরাপত্তাকর্মী জনস্রোত ঠেকাতে লাঠিপেটা করেন। তারপর এক সময় লাঠিপেটা বন্ধ করেছেন এ কারণে যে তাতে আরও বেশি মানুষ মারা যেতে পারে। গরিব মানুষের প্রতি কী নিষ্ঠুর আচরণ! মারা না যাওয়া পর্যন্ত লাঠিপেটাও যেন বন্ধ হয় না! এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। লোকদেখানো জাকাত দেয়ার নামে মানুষ হত্যার অভিযোগে গ্রেফতারও করা হয়েছে কয়েকজনকে। পুলিশের দু সদস্যকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে বলে সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে।

দেশের প্রায় সর্বত্রই চলছে প্রদর্শনবাদিতা। ধনীদের অধিকাংশই তাদের ধনদৌলত জাহির করতে অনেক কিছুই করছেন। তারা জাকাত দেন, তাও সবাইকে জানিয়ে। যদিও পবিত্র হাদিসে আছে, তুমি যখন ডান হাত দিয়ে কাউকে সাহায্য করবে, তখন খেয়াল রাখবে যেন বাঁ হাত জানতে না পারে। অথচ আমাদের অসমতল সমাজে বিকট বৈষম্যময় অর্থনীতি সৃষ্ট দুর্ঘটনায় বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন পিছিয়ে পড়া বিশাল জনগোষ্ঠীর অসংখ্য মানুষ। অভাবের কারণে এরাই অর্থশালীদের তামাশার বলি হচ্ছেন। দৃশ্য দেখে দারিদ্র্য বিমোচনের তাগিদই ঘুরেফিরে সামনে উঠে আসে।