মাদকবিরোধী সমাজিক যুদ্ধ এখন বড্ড জরুরি

নেশাগ্রস্ততা মানুষকে শুধু নিঃস্বই করে না ইতিবাচক কিছু নেশা বড়ও করে। নেতিবাচক নেশার কবলে পড়লে পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে, পরিবার পড়ে ধ্বংসের মুখে। পরিবেশটাও বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। সে নেশা জুয়ারই হোক, আর মারণ কোনো পদার্থেরই হোক। অবশ্য ইতিবাচক তথা কাজের নেশা মানুষকে স্বপ্নের সমান বড়ও করে। এই কাজের নেশায় ক’জন মাতে? নিজেকে নিজের হাতে শেষ করার মারণ নেশার কবলে পড়ে সমাজের উঠতি বয়সী থেকে শুরু করে পেশাজীবীদের অনেকেই ছিচকে চোরে রূপান্তর হচ্ছে, হচ্ছে কুলাঙ্গার। এদেরই একজন চুয়াডাঙ্গা ফার্মপাড়ার সোহেল। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গর্ভধারিণী মা মামলা করতে বাধ্য হয়েছেন। এ মামলায় তাকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে। আদালত জেলহাজতে প্রেরণ করেছে। এরকম উদাহরণ সমাজে অসংখ্য।
কাজপাগল মানুষের জন্য কাজের অভাব হয় না। যারা কাজকে ভয়পায় তাদেরই একসময় হতাশাগ্রস্ত হয়ে বিষণœতায় ভুগতে হয়। যদিও কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়ে বলেন, বেকারত্বই মারণ নেশার কাছে নিয়ে যায়। সঙ্গও নেশাগ্রস্ত করে তোলার জন্য কোম দায়ী নয়। কিশোর বয়সে কৌতূহলবসে একদিন দু’দিন করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই নিজের সর্বনাশও ডেকে আনছে অনেকে। অথচ কাজের নেশায় মেতে উঠলে বেকারত্বও যেমন থাকে না, তেমনই খারাপ সঙ্গে মেশার সময়ও থাকার কথা নয়। তা হলে মারণ নেশার কবলে পড়ে পতনের পথে ধাবিত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কেন? নেশাদ্রব্য সহজলভ্য হওয়ার কারণে? কয়েক মাস ধরে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপারের বিশেষ নির্দেশনায় ও সরাসরি তদারকিতে জেলার সকল ইউনিট পুলিশ লাগাতার মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে। বহু মাদক উদ্ধারও করেছে। গ্রেফতার করে আইনে সোপর্দ করার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এরপরও হাত বাড়ালেই যে মাদক পাওয়া যায় তা অস্বীকার করার জো নেই। তা হলে প্রতিকার মিলবে কীভাবে?
বিশ্বে কিছু দেশ রয়েছে যেখানে মাদককারবারিদের দাপটে সমাজটাই বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে অনিশ্চয়তার প্রহর গুণছে। কিছু দেশ রয়েছে যেখানে মাদকের লেশমাত্র পাওয়া ভার। লুকিয়ে চুরি-চামারি করে কেউ মাদক নিলেও ধরা পড়লেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার অহরহ নজিরও রয়েছে ওইসব দেশে। আবার কিছু দেশ রয়েছে যেখানে মদ প্রকাশ্যে বিক্রি করার বৈধতা থাকলেও মারণ নেশা তথা ড্রাগ জাতীয় নেশাদ্রব্য শক্ত হাতে উৎখাত করা হয়। কিছু সমাজ রয়েছে, যেখানে সামাজিক উৎসব মানেই নিজেদের তৈরি করা মাদক বিতরণ ও পান-সেবনে প্রাপ্ত বয়সীদের বাধ্য করা হয়। আমাদের সমাজে? বিদেশি অতিথিদের জন্য রাজধানীসহ বড় শহরকেন্দ্রিক বিদেশি মদের অনুমোদিত দোকান আছে। দেশে তৈরি মদ দেশের হরিজন সম্প্রদায়সহ যারা অনুমোদনপত্র নেয় তাদের জন্যও কিছু দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকেও মদ কিনে অনেকেই অবৈধভাবে বিক্রি করছে সমাজের চিহ্নিত কিছু স্থানে। আর মারণ নেশা হিসেবে চিহ্নিত কিছু নেশা চোরাকারবারীদের মাধ্যমে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়াচ্ছে।
নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে, আমাদের সমাজের সকলকে এখনও পর্যন্ত কর্মমুখী করে তোলার পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। একেতো ভৌগলিক কারণে আয়েশি আবহাওয়া আমাদের কিছুটা হলেও অলস করেছে, তারপর ভাত-আলু ভারি করে তুলেছে শরীর। এরপর যখন কাজের পরিবেশের বদলে ‘পিছুলোকে কিছু বলে’ পরিস্থিতির মুখে পরম্পরায় প্রজন্ম, তখন কর্মমুখীর বদলে কৌতূহলপ্রবণ উঠতি বয়সীদের কি বিপথগামীতাতেই উৎসাহিত করে না? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হলেও এসব বলে দায় এড়ানো মানে গড্ডালিকায় গা ভাসানো। মারণ নেশার কবলে পড়ে বিগড়ে যাওয়া যে মেয়ে তার পুলিশ কর্মকর্তা পিতা-মাতাকে খুন করে যে দেশে, যে সমাজে নেশার টাকার জন্য সন্তান তার মায়ের বুকে চাকু ধরে, স্ত্রীকে করে রক্তাক্ত, সেই সমাজে মাদকবিরোধী সামাজিক যুদ্ধ যে কেন এখনও শুরু হয়নি সেটাই বড় প্রশ্ন।
অথচ, যে সমাজে মাদকের ফুলকি ওড়ে সেই সমাজের কোনো পরিবারই নিরাপদ নয়।