বিশ্ববিদ্যালয়ের মানহীনতার জন্য কে দায়ী

 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান শনিবার এক সংবর্ধনা সভায় বলেছেন, উচ্চশিক্ষা লাভে আমাদের অর্জন অনেক। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা যায়নি। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ভারত ও চীন মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। আমাদেরও এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। তার এ বক্তব্য নিঃসন্দেহে সত্য ভাষণ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন রাজনৈতিক আন্দোলনে যতোটা, একাডেমিক ক্ষেত্রে অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কিংবা মানববিদ্যার তাত্ত্বিকতায় ততোটা নয়। অন্যদিকে শিক্ষার মান অর্জনের পরিবর্তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করছে, ব্যবসায়িক দিকটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। তবে এ সকল ব্যর্থতার দায় সকলেরই। গুণগত মান নিশ্চিত করতে সরকার, ইউজিসি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারক ও শিক্ষক সমাজের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিলো, তা কেউই রাখেননি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাই মানহীনতায় ভুগছে।

প্রথমত, উচ্চশিক্ষাকে কী দৃষ্টিতে দেখতে হবে, তার ব্যাপারে বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকগণ খুব পরিষ্কার নন। রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন মানবসম্পদ। রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে সেই মানবসম্পদ তৈরি করবে। এজন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করবে। সেই বিনিয়োগের অন্যতম স্থল হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ শিক্ষা-গবেষণার বরাদ্দ না বাড়িয়ে বলা হয়ে থাকে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধি করার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণার স্থল, আয় করার স্থান নয়। বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশই শিক্ষাখাতে ব্যাপক বিনিয়োগ ছাড়া উন্নয়নশীল হতে উন্নত দেশে পরিণত হয়নি। শিক্ষাঙ্গনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, আধুনিক শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, গবেষণায় বিপুল বরাদ্দ না থাকলে দেশের প্রয়োজনানুযায়ী নতুন জ্ঞানের সঞ্চার হবে কী করে? শিল্প ও বাণিজ্য খাতের উপযোগী নতুন আবিষ্কার আসবে কোথা হতে? একটি দেশ সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে না তুললে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা কীভাবে রক্ষিত হবে? বর্তমানের জিডিপি বৃদ্ধির যে হার, তা সম্পূর্ণভাবে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি, তৈরি পোশাক ও শ্রমবাজারে সস্তা শ্রম বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্ফীত হচ্ছে। উদ্বৃত্ত শ্রমবাজারের এ সরবরাহ অসীম নয়। যখন এ শ্রমশক্তির সরবরাহ স্থিতি অবস্থায় আসবে তখনই অনুভূত হবে শিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু এই জায়গায় আমাদের প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নেই, ফলে নতুন জ্ঞানহীনতায় উন্নয়ন কার্যক্রম অচিরেই স্থবির হয়ে পড়বে। ল্যাবরেটরি রয়েছে, কিন্তু তাতে উন্নত সরঞ্জামাদি নেই, একে ঘিরে বৃহৎ গবেষণা-প্রকল্প নেই। অন্যদিকে ইউজিসির কার্যক্রমে বাড়তি কোনো প্রণোদনা নেই। বরং বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ও পরামর্শে প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবায়ন করছে দীর্ঘমেয়াদী এক কৌশলপত্র, যাতে মৌলিক জ্ঞানের (রসায়ন, পদার্থবিদ্যা) পরিবর্তে বাজারমুখী নানা শিক্ষা কার্যক্রমের (ফলিত রসায়ন, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসন) দিকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির বুলিই পুনর্বার আওড়ানো হয়েছে। বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীর পড়াশুনার পথ রুদ্ধ করার আয়োজন সমাপ্ত হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন কাঠামো হিসেবে যা রাখা হয়েছে তা দিয়ে মানবেতর জীবনযাপনই কেবল সম্ভব। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদে ভাগ বসানোর জন্য শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, কিংবা বাড়তি উপার্জনের জন্য এখানে ওখানে দৌড়াদৌড়ি করছেন। অতীতে রাজনীতিবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীদের নিকট আসতেন পরামর্শের জন্য। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতিবিদদের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়ে থাকেন উপাচার্যসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ পাওয়ার লোভে।

শিক্ষার মান এমনি এমনি অর্জিত হয় না। শিক্ষার একটি দর্শনগত দিক থাকে, নীতিগত দিক থাকে। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষাকে ঠিক কীভাবে কাজে লাগানো যাবে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে নীতিনির্ধারকদের। বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ক্লাস নোয়ার স্থান নয়। আর নামমাত্র গবেষণা দ্বারা উন্নয়ন উপযোগী নতুন জ্ঞান সৃজিত হবে না। এজন্য প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ। আমরা সম্ভবত উল্টা পথে হাঁটছি। শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি না করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই বলছি, নিজের খরচ নিজে বহন করতে। এতে বোঝা যায়, কেন্দ্রীয় উন্নয়ন ভাবনায় শিক্ষাকে সাথে রাখে নীতি নির্ধারকরা সামনের দিকে হাঁটছেন না।