ফল বিপর্যয় : সঙ্গত কারণেই কিছু প্রশ্নের জবাব খোঁজা দরকার

আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, মাদরাসা ও কারগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে চলতি বছর অনুষ্ঠিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল গতপরশু প্রকাশ করা হয়। গতবারের চেয়ে এবার জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থী ও উত্তীর্ণের সংখ্যা কম। যশোর শিক্ষাবোর্ডের শিক্ষার্থীদের? কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত তো হয়নি, দেশের অন্য শিক্ষাবোর্ডগুলোর তুলনায় ভয়াবহ ফল বিপর্যয় হয়েছে। আর চুয়াডাঙ্গার ফলাফল? সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে ঢালাও কোচিঙের পর পঠনপাঠন নিয়ে প্রশ্নে এখন উদ্বিঘ্ন অভিভাবকমহল। গতকাল সমন্বয় বৈঠকে অভিভাবক ফোরামের নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রেক্ষিতে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকও বিপর্যয়ের ফলাফলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। যশোর বোর্ডে শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী কৃতকার্য হতে পারেনি। আর চুয়াডাঙ্গার কলেজগুলোর দশা আরও করুণ। পাসের হার যেমন ঠেকেছে তলানিতে, তেমনই জিপিএ-৫ প্রাপ্তের সংখ্যা হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ফল বিপর্যয় অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের জন্য মানসিক বিপর্যয়েরও কারণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছে ৬৯.৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। জিপিএ ৫ পেয়েছে ৪২ হাজার ৮৯৪ জন। গত বছর এ পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ; ৭০ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছিলো। আটটি সাধারণ বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ডের অধীনে আট হাজার ৩০৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০ লাখ ৬১ হাজার ৬২৪ জন শিক্ষার্থী এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়। এদের মধ্যে পাস করেছে সাত লাখ ৩৮ হাজার ৮৭২ জন। উচ্চ মাধ্যমিকে এবার পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের চেয়ে কমে যাওয়ার জন্য বছরের শুরুতে বিএনপি ও জামায়াতের টানা হরতাল-অবরোধকে দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য যশোর শিক্ষাবোর্ড কর্তা কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তিনি ফল বিপর্যায়ের জন্য ইংরেজি ও সৃজনশীল পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন এমন শিক্ষক দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়নসহ কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করেছেন।

জিপিএ-৫ ও পাসের হারের ঊর্ধ্বমুখি সূচক শিক্ষার মানের বিষয়টি নিশ্চিত না করলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঠন পাঠনে ঘাটতির বিষয়টি অস্বীকার করা যায় কি? শিক্ষার মান কতোটা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা যেমন খতিয়ে দেখা দরকার, তেমনই পাশের হার কেনো হ্রাস পেলো তা তদন্ত করে দেখার দাবি অবজ্ঞাযোগ্য নয়। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে প্রয়োজন মানসম্মত শ্রেণিকক্ষ, যা নির্ভর করে মানসম্পন্ন শিক্ষকের ওপর। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। দেশের সেই ভবিষ্যত নাগরিকদের গড়ে তোলার দায়িত্ব যাদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে তাদের মান হতে হবে প্রশ্নাতীত। শুধু জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়িয়ে বা কমিয়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাবে না। যে শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পাস করে আসছে তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই। আজকের দিনের সাথে সঙ্গতি রেখে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি উদ্যোগেই বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের পছন্দের বিষয়ে আসন বাড়াতে হবে। অন্যথায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা-বাণিজ্য প্রতিরোধ করা যাবে না। নিশ্চিত করা যাবে না মানসম্মত উচ্চশিক্ষা। একই সাথে দৃষ্টি দিতে হবে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। শহরের সাথে গ্রামের শিক্ষার্থীদের ফারাক বাড়ছে। তার অন্যতম উদাহরণ আলমডাঙ্গার জামজামি কলেজসহ কয়েকটি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার এবারের ফলচিত্র।

নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে, শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হলে সর্বত্র শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার পরিবেশ। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণে মনোনিবেশ করাতে না পারলে পাসের হার বৃদ্ধি পাবে কীভাবে? গত বছরও এইচএসসিতে কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জিত হয়নি। কাঙ্ক্ষিত ফল কেন অর্জন করা যাচ্ছে না সেদিকে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এবারের কৃতকার্য পরীক্ষার্থীদের অভিনন্দন। উজ্জ্বল এই শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতই আমাদের কাম্য। অকৃতকার্য এবং যারা কাঙ্ক্ষিত ভালো ফল পায়নি তাদেরকে হতাশ না হয়ে নবোদ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান আমাদের। তাছাড়া, অভিযোগ রয়েছে- চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজসহ যেসব কলেজে যতোটা না দরদ দিয়ে ক্লাস নেয়া হয়, তার চেয়ে অধিক গুরুত্বে কোচিং করানো হয়। কোনটি কোচিং, কোনটি ক্লাস তা বোঝা ভার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কোচিং যখন পিছিয়ে পড়া বা দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য, তখন কোচিং করিয়েও পাসের হার তলানিতে কেন? সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্নের জবাব খোঁজা দরকার।