নারী জাগরণে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য

বাংলাদেশে নারী সম্পাদকদের কথা বললে প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসবে বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগমের নাম। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে নারীদের প্রথম সাপ্তাহিক সেই বিখ্যাত বেগমের সম্পাদক নূরজাহান বেগম আর নেই। এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হওয়ার নয়। স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার সকাল ১০টার দিকে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।  ৯১ বছর আগে এক অনগ্রসর সমাজে তার জন্ম। যখন পর্দা ছাড়া কোনো নারীর ঘর থেকে বাইরে যাওয়া প্রায় নিষিদ্ধ, সেই অন্ধকার সময়ে তিনি মনোনিবেশ করেছেন পড়ালেখায়। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল থেকে পাঠগ্রহণ শুরু। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ভর্তি হন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। বাড়িতে সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা ছিলো। তার বাবা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ছিলেন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক। বাবার হাত ধরেই সংবাদপত্রের জগতে পা রাখা। মেয়েদের সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে নেয়ার প্রয়াসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ব্যবস্থাপনায় ১৯৪৭ সালে বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। শুরুতে এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, নূরজাহান বেগম ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে পত্রিকাটি চলে আসে ঢাকায়। দেশের অনেক নারী সাহিত্যিক ও সাংবাদিকের হাতেখড়ি বেগম পত্রিকার মধ্যদিয়ে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বেগম পত্রিকার পাঠকপ্রিয়তা ছিলো চোখে পড়ার মতো। বেগম পত্রিকা ঘিরে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন বেগম ক্লাব।

নূরজাহান বেগম যে সমাজে জন্মেছিলেন, সেখানে নারীর স্বাধীনতা বলতে প্রায় কিছুই ছিলো না। সামাজিক কোনো মর্যাদাও ছিলো না। নূরজাহান বেগম সেই প্রথার বিরুদ্ধে প্রথমে নিজে দাঁড়িয়েছেন, তারপর নারীদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। শুধু যদি বেগম পত্রিকার কথাই ধরা হয়, তাহলে বলতে হবে সেই সময়ের সামাজিক বাস্তবতায় বেগম ছিলো একটি বড় ধরনের বিপ্লব। কোনো নারী যে স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন, বেগম পত্রিকাই তা করে দেখিয়েছিলো। শুধু নারীদের লেখাকে কেন্দ্র করে ১৯৪৬-৪৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত একটি পত্রিকা তার প্রকাশনা ধরে রেখেছে, এ ঘটনাও বিরল। পাঠকদের ভালোবাসাই বেগম পত্রিকার সবচেয়ে বড় অর্জন। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নিরলস শ্রম ও মেধা দিয়েছেন নূরজাহান বেগম। এক অন্ধকার সময়ে জন্ম নিলেও বাবার সাহায্য তাঁকে সাহস জুগিয়েছে। সামনে আদর্শ হিসেবে ছিলেন বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল। সেই আদর্শের দীপশিখা আজীবন জ্বালিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এখন সব পেশায় নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। রাজনীতিতে নারীরা চলে এসেছেন সামনের সারিতে। এমনকি এভারেস্টের চূড়ায়ও পদচিহ্ন এঁকেছেন বাংলাদেশের নারী। দেশে আজ নারী জাগরণ ঘটেছে। এই নারী জাগরণের অন্যতম অগ্রদূত নূরজাহান বেগম।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। সরকারের পক্ষ থেকে ভূষিত হয়েছেন রোকেয়া পুরস্কারে। বাংলাদেশের নারীর মননশীলতার বিকাশে তার অবদান তাকে চিরদিন স্মরণীয় করে রাখবে। এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর নেই। আজ একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী দেশকে আবার অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। এই দুঃসময়ে নূরজাহান বেগমের মতো অগ্রণী নারীর মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।