দুর্নীতির শেকড়-বাকড় সমাজের রসদ চুষে নেয়, নিচ্ছে

রাস্তাঘাট, সরকারি আধা সরকারি স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ মানেই যেন নিম্নমানের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগের পর অভিযোগ করেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত প্রতিকার মেলে না। এ কারণে মাঝে মাঝে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে প্রকাশ্যে করা নির্মাণ কাজের সামনে প্রতিবাদীদের অনেকে আঁড় হয়ে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। যদিও কাজে বাধা দিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়া আইনসিদ্ধ নয়, এই সুযোগটাও অবশ্য অনেক ঠিকাদার নিয়ে ঠুকে দেয় মামলা। সব মামলাই যে সুযোগের সদ্বব্যবহার তাও নয়। অনেক ক্ষেত্রে চাঁদা চেয়ে না পেয়ে নিম্নমানের কাজের অভিযোগ তুলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিরও উদাহরণ অহরহ। তবে চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের ছয়ঘরিয়া খালের ওপর নির্মাণাধীন ছোট ব্রিজের কাজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে নির্মাণের যে গণঅভিযোগ উত্থাপন হয়েছে তা ওই গতানুগতিকতার বাইরে। ফলে অভিযোগের গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অন্যথায় অভিযোগ উত্থাপনকারীরা প্রশাসনের ওপর হারাবেন আস্থা। তার কুপ্রভাব পড়বে সমাজে। অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপন করে প্রতিকার না পেলে পুঞ্জিভূত হয় ক্ষোভ। যা বারুদের চেয়ে ভয়ানক।
সরকারি স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ কাজে দুর্নীতি অনিয়ম অনেক ক্ষেত্রেই শুরু হয় মূলত প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন প্রস্তুত থেকেই। কোনো কোনো কাজ নাকি খরচ করে ঠিকাদার বরাদ্দসহ অনুমোদন নিয়ে আসেন। মাঠপর্যায়ে ওই কাজ করার অধিকার অলিখিতভাবে ওই ঠিকাদারেরই হয়ে যায়। যে কাজের প্রকল্প করে নিয়ে ঠিকাদার নিজেই অনুমোদনসহ বরাদ্দ করিয়ে আনেন সেই কাজের পরিণতি কেমন হতে পারে তা বোদ্ধাদের বুঝতে নিশ্চয় অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া দাপ্তরিকভাবে কিছু কাজের নকশা প্রণয়ন, প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে অনুমোদন হয়ে আসার পর যখনই ঠিকাদার নিযুক্ত করার দরপত্র আহ্বান করা হয় তখনই পছন্দের ঠিকাদারের তালিকা সামনে উঠে আসে। তারপর রয়েছে শতাংশের হিসেব। এখানে ৩ শতাংশ, ওখানে ১৩। এরপর নির্মাণ কাজ দেখভালের জন্য যাদের দায়িত্ব তাদের তো উঠতে বসতেই খুশি করাসহ থেকে টাকা দেয়ার প্রচলন রয়েছেই। এতোকিছুর পর ঠিকাদার দেখেন তার কতো থাকছে। ফলে নির্মাণকাজ বরাদ্দের কতাংশের টাকায় নির্মাণ হচ্ছে তা একটু খতিয়ে দেখলেই অনুমান করা যায়, ওই নির্মাণকাজের কেমন দশা হয়েছে। কবে নাগাদ ধসে পড়তে পারে তাও বুঝতে বা অনুমান করতে খুব একটা বেগ পাওয়ার কথা নয়।
দুর্নীতি একদিনে ব্যাপকতা পায় না। প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় উদ্যোগের পাশাপাশি পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে দুর্নীতির শেকড় সমাজের গভীর থেকে গভীরে ছড়ায়, ছড়িয়েছেও। তা না হলে কি সরকারি ভবন নির্মাণ কাজে রডের বদলে বাঁশের কাবারি দেয়? দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, দুর্নীতির এই চাক্ষুস প্রমাণ চুয়াডাঙ্গারই দর্শনায় বিদ্যমান। দুর্নীতির শেকড়-বাকড় সমাজের রসদ চুষে নেয়, নিচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি অর্থায়নে নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নির্মিত অবকাঠামোর ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই আঁতকে উঠতে হয়। নির্মাণকাজ শেষ হতে না হতে স্থাপনার দশা দেখে অনেকেই মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘পুরোনো ভবনই তো এর চেয়ে ভালো ছিলো। ধসলেও কোড়ে-বর্গায় অন্তত প্রাণটা বাঁচাতো। এখন? আস্ত দূরের কথা অনেকের অস্তিত্বই পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে ওই দুর্নীতিবাজদেরই বরঞ্চ সুবিধাই হবে, ওরা বেমালুম প্রাণহানির সংখ্যা কমাতে পারবে।’ এই যখন অবস্থা, তখন ছয়ঘরিয়া খালের ছোট ব্রিজের নির্মাণকাজে মানসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কতোটুকুই বা আশা করা যায়। তারপরও প্রতিকার প্রার্থনা করে অভিযোগ উত্থাপন কম কথা নয়। এটা অবশ্যই সমাজের সামাজিক দায়বদ্ধতারই অংশ।