দান হোক দুস্থের সচ্ছল হওয়ার সোপান

 

কে আসল, কে নকল, আর কার কখনকার কান্নাটা কতোটা মেকি তা হঠাৎ করে বোঝা বড্ড কঠিন। সে কারণেই ভাসমান ভিক্ষুকের চেয়ে আত্মীয় আর পড়শীদের মধ্য থেকে প্রকৃত দরিদ্র্য খুঁজে জাকাত দানে সওয়াব বেশি। একই সাথে লোক দেখানো জাকাত দানও বারণ। অথচ অনেকেই আছেন, যারা নিজেদের ধনী বোঝাতে লম্বা লাইনে দরিদ্র্য নারী-পুরুষ শিশু-কিশোরদের দাঁড় করিয়ে জাকাত দেন। অনেক সময় হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে গরিবদের প্রাণও হারাতে হয়। ওভাবে জাকাত নিয়ে ক’জন সচ্ছলতা পায়? অভাবটা থেকেই যায়।

সম্প্রতি দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বহিরাগত ভিক্ষুকের হালচিত্র তুলে ধরা হয়। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় বহিরাগত ভিক্ষুকদের অধিকাংশই যে মরসুমি এবং স্বভাবি তা অস্বীকার করার জো নেই। ওদের ভিড়ে স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রকৃত দরিদ্র্যরা দানশীল পরিবারের বাড়ির দরজায় দাঁড়ানোর সুযোগ পায় না। যদিও ভিক্ষাবৃত্তি অসমর্থিত একটি পেশা। কেননা, অভাবের কারণে এক সময় হাত পাতা শুরু করলেও পরবর্তীতে তা স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়। চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার পল্লি সাহেবপুর তারই এক উদাহরণ। যদিও ওই গ্রামের ভিক্ষুকদের নিয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর অনেকেরই বিবেক জেগেছে, বেড়েছে আত্মমর্যাদা। এখন ওই গ্রামের অনেকেই আছেন যারা নিজেদের সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে বিদ্যালয়ে পাঠায়। সকালে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ভিনগ্রামর দিকে ছোটার বদলে ঝুড়ি কোদাল নিয়ে শ্রম বিকানোর জন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে গিয়ে দাঁড়ান। কাজ করে উপার্জিত অর্থে হাট থেকে চাল-ডাল তরিতরকারি কিনে থলিভরে গর্বে বুক উঁচিয়ে বাড়ি ফেরেন। কুর্নিশ তাদের।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক- মানুষ কেন গরিব হয়, কেন পিছিয়ে পড়ে কেউ কেউ? জবাব বিষদ হলেও স্বল্প কথা বলতে গেলে যা দাঁড়ায় তা হলো সমাজের অসম প্রতিযোগিতা আর অধিকার সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা। তা না হলে সন্তানের চিকিৎসার জন্য কেন কোনো কোনো পিতা-মাতাকে সর্বস্ব হারাতে হয়? কেনই বা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিশ্চয়তা না পেয়ে বস্তিবাসী হয়ে দফায় দফায় উচ্ছেদে হারাতে হয় চাল-চুলো? যে সমাজে ব্যক্তি হয় ব্যক্তি কেন্দ্রিক, সমষ্ঠি হয় মানবতাহীন সেই সমাজে ধনী-গরিব বৈষম্য অনিবার্য নয় কি? তবে অলসতার খেতাব খুঁইয়ে সময়ের স্রোতে উজান বেয়েও যে কেউ কেউ মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়াচ্ছেন না তাও নয়। ওদেরই দরকার সহমর্মিতা, সহযোগিতা।

অবশ্যই লক্ষ্য নির্ধারণ করে লক্ষ্যে পৌঁছুনোর মতো পরিকল্পিত শ্রম যেমন দরকার তেমনই দরকার পরিবেশও। আমাদের সমাজে তথা দেশে সেরকম পরিবেশ কতোটা গড়তে পারছি আমরা? কর্মসংস্থানের জোগান নেই বলেই যারা পারছে তাদের অধিকাংশই ঝুঁকি নিয়ে হলেও ছুটছেন প্রবাসে। তাদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের দেশের তহবিলকে করছে সমৃদ্ধ। আর সেটাও যারা পারছেন না তাদের পুঁজি বেলা শেষে দীর্ঘশ্বাস। নানা কারণে পিছিয়ে পড়া পরিবার দূরাস্ত, পিছিয়ে পড়া কারো পুনর্বাসনের দাবি যে সমাজে ধুলণ্ঠিত সেই সমাজে হাত-পাতা মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়? সে কারণেই বাড়ির পাশের পিছিয়ে পড়া অর্থাৎ অসচ্ছল পরিবারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তাকে এগিয়ে নেয়ার নির্দেশনা যেমন ধর্মে, তেমনই বিবেকবানের দায়িত্বও বটে।

অনেকেই আছেন যারা প্রতিবছর জাকাতের টাকা দিয়ে গোপনে দরিদ্র্য বিমোচনে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে আলমডাঙ্গার প্রভাবশালী মোল্লা পরিবারের এক সদস্য (পরিচয় প্রকাশে আপত্তি) রয়েছেন তিনি ঢাকায় ব্যবসা করলেও আপন এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নিজের মতো করে। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে অসংখ্য মানুষ রয়েছেন, যাদের অবদান কখনই পত্রস্থ হয় না, হয়তো হবেও না। তাদের দান যারা গ্রহণ করে সচ্ছলতা পেয়েছেন, পাচ্ছেন তাদের দোয়া নিশ্চয় মহান সৃষ্টিকর্তা কবুল করবেন। আমিন।

প্রসঙ্গত: জাকাত সরকারের তহবিলে দিয়েও সুন্দর সমাজ গঠনে অবদান রাখা যায়।