জাতীয় চার নেতার স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা

 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্ষ বিদীর্ণ করে জাতীয় জীবনে লেপন করে দেয়া হয় অমোচনীয় কলঙ্কের দাগ। তার মাত্র দুইমাস আঠারো দিনের ব্যবধানে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র আবারও আঘাত হানে জাতির হৃদপিণ্ডে। ৩ নভেম্বর নাজিমুদ্দিন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করে অশুভ শক্তি। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতিদ্রোহী ঘাতকচক্র সংযোজন করে বর্বরতার আরও একটি নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরিত হয়েছে। পুরাতন কারাভবনটি সাক্ষী হয়ে রয়েছে জাতিদ্রোহী ঘাতকদের পাশবিকতার। ১৫ আগস্টে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির ক্রীড়নক নরপিশাচের দল জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করে দেয়ার উদ্দেশে কারাভ্যন্তরে ঠাণ্ডামাথায় হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান- এই চারনেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহযোগী ও সহচর। বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে তারা পালন করেন অনন্যসাধারণ ভূমিকা। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে জাতির জনকের অনুপস্থিতিতে তারাই নেতৃত্ব প্রদান করেন, বহন করেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকা। শোকাবহ ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর- উভয়ক্ষেত্রেই অশুভ শক্তির করতলগত রাষ্ট্র শুধু যে তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলো, তাই-ই নয়, বরং সভ্য সমাজের সকল রীতিনীতিকে পদদলিত করে রুদ্ধ করা হয়েছিলো বিচারের পথও। নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দেয়া হয়েছিলো ঘাতকচক্রকে।  এই কালিমা শুধু যে আমাদের গণতন্ত্রের পথকেই অতীতে বার বার বিপন্ন করেছে তা নয়, জাতির সার্বিক অগ্রযাত্রার পথেও গুরুতর বাধা হয়ে দেখা দিয়েছিলো।

দীর্ঘদিন পরে হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। জেলহত্যার বিচারও সম্পন্ন হওয়ার পথে। এটি স্বস্তির বিষয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই খলনায়কদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার যারা বহন করেন আজও পর্যন্ত তাদের বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, আধুনিক রাষ্ট্রে কারাগারকে সর্বাপেক্ষা নিরাপদ স্থান বলে বিবেচনা করা হয়। কারণ সরকার বা রাষ্ট্রই কারাবন্দীদের নিরাপত্তা বিধান করে থাকে। সেই কারাগারের মধ্যেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এটি প্রত্যাশিত ছিলো যে, জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে রাজনীতিকরা সোচ্চার হবেন এবং হত্যাকারীদের বিচারের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করবেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই ঐকমত্য দূরে থাকুক বরং বাস্তবে তখন ঠিক তার উল্টোটাই ঘটেছে। গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো আইনের শাসন। আইনের হাতকেও তখন শৃঙ্খলিত করা হয়েছিলো।

স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক কোনো দেশে হত্যা ও হানাহানির স্থান থাকতে পারে না। হিংসা কেবল হিংসার পথই প্রশস্ত করে। হত্যা কেবল আরও হত্যাকেই অনিবার্য করে তোলে। ইতিহাসই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। হিংসা এবং অসহিষ্ণুতার রাজনীতির এই দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসার পথ একটাই। তা হলো- শান্তি, সহিষ্ণুতা এবং গণতন্ত্রের অবিচ্ছিন্ন ধারা। আজকের এই শোকাবহ দিনে আমরা কামনা করি শহীদ চার জাতীয় নেতার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত। আর তাদের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।