জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী আজ

 

বঞ্চিত লাঞ্ছিতদের যিনি শুনিয়েছেন জাগরণের গান, উজ্জীবিত করেছেন অভয়মন্ত্রে, তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি বিশেষণে তিনি সমধিক পরিচিত। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, কবির ১১৬তম জন্মবার্ষিকী।

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষিত অকুতোভয় তেজদীপ্ত এক জীবন সাধক। তিনি গানের বুলবুল, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী কলমযোদ্ধা। তিনি দুখু মিঞা। দেখেছেন নিদারুণ দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে দীর্ণ-শীর্ণ হতে। সে কারণেই হয়তো শৈশবেই তিনি ছিলেন বেপরোয়া এক জীবনসন্ধানী। জীবনসত্য অন্বেষণ করতে তিনি ছুটেছেন নিরন্তর। তিনি চঞ্চল, অস্থির, কখনওবা দারুণ অভিমানী। অভিমানই তাকে বিদ্রোহী করেছে। তিনি নিজেও তা স্বীকার করেছেন। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘এই বাঁধনহারা মানুষটি ঘরোয়া আঙিনা পেরিয়ে পালাতে চেষ্টা করেছে। যে নীড়ে জন্মেছে এই পলাতক, সেই নীড়কেই অস্বীকার করেছে সর্বপ্রথম উড়তে শিখেই।’ কখনও যাত্রা দল, কখনও লেটোর দলের সাথে ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগত্টাকে’ পণ অক্লান্ত ছুটার পথে চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গাতেও কাটিয়েছেন কিছুদিন। তাঁর স্মৃতিবিজড়িত কার্পাসডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কবির জন্মদিন উপলক্ষে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাস। সাম্যের আহ্বান।

দারিদ্র্যের কষাঘাত কী, তা নজরুল ইসলামের মতো আর ক’জন অনুভব ও অবলোকন করেছেন? দারিদ্র্যের অভিশাপকে তিনি শক্তিতে রূপান্তরিত করেই রেখে গেছেন অনন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। দারিদ্র্য তাঁর নিকট হয়ে উঠেছিলো অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস; উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার। তিনি কণ্ঠে ঢেলেছেন তরল গরল। অমৃত তার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই উদ্ধত জিজ্ঞাসা তার অমৃতে কি ফল? দুঃখের ধরিত্রীতে অমৃতের সাধনা তার নয়। দারিদ্র্যের গরলে নীলকণ্ঠ হওয়ার জন্য, সেই যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়ার জন্যই জগতে ছিলো তাঁর আগমন। জীবন-সংগ্রামের পুরাণ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি ও মানবিকতার অন্তর্নিহিত সত্যজগতে তিনি তার দৃষ্টিকে করেন অতলস্পর্শী। সেই চাঞ্চল্যেই তিনি একাধারে হয়ে ওঠেন কবি, কথাশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ ও সৈনিক। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বজ্র কণ্ঠের প্রতিফলন মেলে তার কবিতা ও গানে।

বিদ্রোহের মঞ্চে তার প্রবেশ যেন অগ্নিবীণা হাতে করে, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। ‘ধূমকেতু’ নামের রাজনৈতিক কাগজ তিনি প্রকাশ শুরু করেছিলেন ১৯২২ সালে। ‘ধূমকেতু’র মাধ্যমে তিনি তত্কালীন পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুলে ধরেন। ঘোষণা করেন, পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে সকলের আগে সকলকে ‘বিদ্রোহ’ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর বজ্রকম্প দীপ্ততেজ দেখে লিখেছেন, ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এ দুর্গ শিরে, উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। স্বদেশী আন্দোলনে নূতন কোনো আশা জাগানিয়া ঘটনা দেখলে তিনি মেতে উঠিতেন প্রলয়োল্লাসে-ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখির ঝড়। তার চেতনা লোপজনিত অসুস্থতা প্রকাশ পাবার কয়েক মাস পূর্বে, ১৯৪১ সালের এপ্রিলে, কোলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে জীবনের শেষ অভিভাষণ পাঠ করতে গিয়ে কবি তাঁর জীবনের লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেন। জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব দেখে তিনি বলেন, প্রাণের ভেতরের যে সত্য, যে ধর্ম, তার উপর কোনো ধর্ম নেই। তিনি আমাদের সেই চিরন্তন মানবতার সঙ্গীতই শুনিয়েছেন নিরন্তর। তিনি গেয়েছেন সাম্যের গান।

তিনি বলেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। আজ তাঁর জন্ম-জয়ন্তীতে দিকে দিকে উচ্চারিত হোক মানবতা ও সাম্যের গান। দূর হোক হিংসা বিদ্বেষ। কবির জন্মদিনে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা।