জনতার হাতে লাঠি ও জননিরাপত্তা

 

চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে রীতিমতো সমাবেশ করে স্থানীয় জনগণের হাতে লাঠি-বাঁশি তুলে দিয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ। এর আগে মাগুরাতেও একই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন যে, ধারাবাহিক গুপ্তহত্যা ও জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনোবল ও সচেতনতা বৃদ্ধিই তাদের এই উদ্যোগের লক্ষ্য। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে, অনুরূপ উদ্যোগ আগেও নেয়া হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশ বাহিনীর বিদ্যমান আইনের সাথেও তা সাংঘার্ষিক নয়। তা সত্ত্বেও, এই উদ্যোগ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কোনো কোনো মানবাধিকার কর্মী মনে করেন যে এটি নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের সর্বোত্তম পন্থা নয়। তাদের অন্যতম প্রধান যুক্তি হলো, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রের- আরও নির্দিষ্ট করে বললে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। নাগরিকদের হাতে এই দায়িত্ব তুলে দেয়া হলে তার অপব্যবহারেরও আশঙ্কা রয়েছে বলে তারা মনে করেন। অন্যদিকে প্রসঙ্গক্রমে পুলিশের আইজি বলেছিলেন যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী মানুষের ঘরে ঘরে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। নাগরিকদের নিজস্ব নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে হবে। তবে পুলিশ অবশ্যই এলাকাবাসীর পাশে থাকবে। বুঝিতে অসুবিধা হয় না যে তিনি মূলত সন্ত্রাস মোকাবেলায় পুলিশ ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগের ওপরই গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব যে রাষ্ট্রের- তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বব্যাপী নিরীহ জনসাধারণের ওপর গুপ্ত হামলার পাশাপাশি সার্বিকভাবে সহিংসতার মাত্রা যেইভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে- তাতে উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই এককভাবে জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষত গুপ্তহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীরা যেসব কৌশল অবলম্বন করছে জনগণের সহায়তা ছাড়া তাদের শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। এই ক্ষেত্রে সর্বস্তরের জনগণের সচেতন ও সংঘবদ্ধ ভূমিকা বা প্রতিরোধ যে অপরিহার্য হয়ে পড়ছে- বিশ্ব নেতৃবৃন্দও তা অকপটে স্বীকার করছে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের জনগণের হাতে যে লাঠি-বাঁশি তুলে দেয়া হয়েছে- তার একটি প্রতীকী তাত্পর্যও রয়েছে। সেটি হলো- জনগণকেও নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি এটিও বিস্মৃত হলে চলবে না যে নিরাপত্তার স্বার্থে জনগণের হাতে আইনসম্মতভাবে অস্ত্র তুলে দেয়ার দৃষ্টান্তও নতুন নয়। এমন দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সম্মুখেই রয়েছে। প্রাণঘাতী এই অস্ত্রের অপব্যবহার যে হচ্ছে না তা নয়। অতি সম্প্রতিও যুক্তরাষ্ট্রে অর্ধশত মানুষের প্রাণহানির মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। দেশটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এর পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক তর্কও চলছে দীর্ঘদিন যাবত। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিদ্যমান আইনটি বহাল রাখার পক্ষেই পাল্লা ভারী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

বাস্তবতা হলো, সহিংসতা ক্রমেই লাগামহীন হয়ে উঠছে। কারণে-অকারণে রক্ত ঝরছে বিশ্বের দেশে দেশে। কিন্তু কারও বোধোদয় হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকর্তৃক গৃহীত নিরাপত্তার ক্রমবর্ধমান বজ্র আঁটুনিও রুখতে পারছে না এই রক্তস্রোত। এমন একটি প্রেক্ষাপটে আত্মরক্ষার্থে রাষ্ট্রের পাশাপাশি জনগণের সর্বাত্মক সচেতনতা ও সক্রিয় ভূমিকার কোনো বিকল্প আছে বলে তো মনে হয় না।