ঘটনার আড়ালের ঘটনাও উন্মোচন প্রয়োজন

 

মাঝে মাঝেই মা তার শিশু-সন্তানদের নিয়ে আত্মঘাতী হয়। ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ারও উদাহরণ কম নয়। কেউ কেউ আত্মঘাতী হওয়ার আগেই সন্তান হত্যার সময় ধরাও পড়ে। যে মায়েরা এরকম হয়, তারা কি শুধুই মানসিক ভারসম্য হারানো? কেন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারালেন, কে বা কারা দায়ী? আড়ালে থাকা তথা প্ররোচনার দায়ে দায়ীদের ক’জনকেই আর আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারি? ঘটনার আড়ালে এমন কিছু ঘটনা থাকে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধামাচাপা পড়ে যায়। এ কারণেই আড়ালের অপরাধী পার পায়, আর তার কু-প্রভাব সমাজকেই বহন করতে হয়। দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা সমাজের ছোট্ট সমস্যাও একপর্যায়ে প্রকট রূপ নেয়।

ঝিনাইদহ কোটচাঁদপুরের সলেমানপুরের রাফেজা তার আড়াই বছর বয়সী কন্যা সন্তান হত্যার পর ৮ বছর বয়সী ছেলে সন্তান হত্যার সময় ধরা পড়েছেন। দু সন্তানকে হত্যা করে কি রাফেজা আত্মঘাতী হয়ে চেয়েছিলেন? এ প্রশ্ন অমূলক নয়। রাফেজার সংসার ছিলো সাজানো। অশান্তির আগুন তখনই জ্বলে ওঠে যখন তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে নতুন সংসার পাতে। রাফেজা অসহায় হয়ে পড়েন। সেই অসহায়ত্ব রাফেজাকে সত্যিই মানসিকভাবে বিষিয়ে তুলেছে? নাকি দু সন্তানের মুখে আহার তুলে দিতে না পেরে তিনি ওই রাতে পাষাণী হলেন? যেহেতু রাফেজা এই সমাজেরই মানুষ, সন্তানের মা। সঙ্গত কারণেই রাফেজার বাস্তবতাকে অস্বীকার করা উচিত হবে না। তিনি সন্তান হত্যা করেছেন, হত্যার বিচার হবে। কেন তিনি পাষাণী হলেন, কেন তিনি সন্তান হত্যা করলেন তা সুচারুভাবে খতিয়ে দেখে আড়ালের অপরাধীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া জরুরি নয়কি?

অবশ্যই সমাজ সুন্দর তথা সম্ভাবনার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছ। তবে গতি যে কাঙ্ক্ষিত নয় তা অস্বীকার করা যায়। নারীসামাজ যতো শিক্ষিত হবে, সমাজের নারীরা যতো স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারবে অগ্রযাত্রার গতি ততোটাই ত্বরান্বিত হবে। পারিবারিক নির্যাতন রুখতে এবং সমাজের রাফেজাদের অসহায়ত্ব থেকে রক্ষা করতে হলে যেমন দরকার নারীশিক্ষা ও তাদের স্বনির্ভরতা অর্জনে সম্মানজনক পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান, তেমনই প্রয়োজন নারীদের মানসিকতারও পরিবর্তন। পুরুষ পারে, নারী পারে না। কেন? সামাজিক রীতি এবং দীর্ঘদিনের লালিত মানসিকতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানসিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জনে অন্তরায়। মূলত সেই অসহায়ত্ব থেকেই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার পথে পা বাড়ান অনেকে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। দেশের প্রচলিত আইনও সমর্থন করে না। পরাজয় নয়, জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার মতোই মানসিকতা লালন করতে হবে।

আত্মহত্যা সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা দূর করতে হলে প্রয়োজন প্রতিটি ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত। প্রকৃত নেপথ্য উন্মোচনের বদলে আড়াল করলে সমস্যা বাড়ে। গতানুগতিকভাবে পেটের পিড়া, মস্তিষ্ক বিকৃত বলে সকল আত্মহত্যাই যদি আইন সিদ্ধ করা হয়, তাহলে আত্মহত্যা প্রবণতা যেমন হ্রাস পাবে না, তেমনই আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীরা পার পেয়ে বড় ধরনের অপরাধী হয়ে উঠবে। বিষয়টি উপলব্ধি করার পাশাপাশি মানসিক ভারসম্য হারানো মা কেন যথাসময়ে চিকিৎসা পেলেন না তাও পঙ্খানুপঙ্খানুভাবে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ প্রয়োজন। স্বামীর অবহেলার বিচার রাফেজা চাননি বলে হয়তো পাননি, চিকিৎসা পাওয়াটা তো অধিকার। সেক্ষেত্রে অবহেলার দায় কার?