একের পর এক শিশু অপহরণে ও খুন-গুম

 

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা থেকে গত ২৯ জুলাই অপহরণ করা হয়েছিলো চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মাহফুজ আলম সজিবকে (১৪)। এক মাস পর একটি সেপটিক ট্যাংকে মিললো সজিবের গলিত লাশ। অপহরণের পর দুর্বৃত্তরা তার পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলো। পরিবার সেই টাকা দিতে পারেনি। তাই মাহফুজকে খুন করে লাশ সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেয়া হয়। এতেই ক্ষান্ত হয়নি অপহরণকারীরা। ট্যাংকের মুখে স্ল্যাব বসিয়ে ঢালাই করে দেয় তারা। কী নির্মম এই হত্যাকাণ্ড। টাকার লোভ মানুষকে কী রকম পাষণ্ড করে তোলে!

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে ৪৭০ শিশুকে অপহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১৫ শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। সাধারণত দেখা যায়, দুটি কারণে অপহরণের ঘটনা ঘটে। প্রথমত, টাকার জন্য। দ্বিতীয়ত, প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অপহরণকারীরা শিশুদের টার্গেট করছে। কিন্তু কেন। তারা সেভাবে প্রতিরোধ করতে পারে না বলে? টাকা না পেলেই শিশুকে হত্যা করতে হবে কেন? অনেক সময় টাকা দিয়েও শিশু উদ্ধার হয় না। অপহরণকারীরা টাকাও নেয়, শিশুদেরও মেরে ফেলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিকটাত্মীয় ও এলাকার লোকজন শিশু অপহরণের সাথে জড়িত থাকে। গত ৩০ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জে অপহৃত হয় ১১ বছরের শিশু আবদুল্লাহ। অপহরণের পাঁচ দিন পর গত ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কেরানীগঞ্জের মুগার চর এলাকার একটি বাড়ির ড্রাম থেকে আবদুল্লাহর গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অপহরণকারীরা আবদুল্লাহর পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিলো। তার পরিবার দুই লাখ টাকাও দিয়েছিলো। কিন্তু তাতে মুক্তি মেলেনি আবদুল্লাহর। পরে জানা গেলো, মায়ের মামা, অর্থাৎ আবদুল্লাহর নানা এই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের চার শিশুকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। অপহরণের পাঁচ দিন পর ১৭ ফেব্রুয়ারি মাটি খুঁড়ে চার শিশুর লাশ উদ্ধার হয়। পারিবারিক বিরোধের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ রকম আরও যে কতো শিশু অপহৃত হয়েছে এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অনেকে শিশু অপহরণকে টাকা রোজগারের সহজ উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্যের বিরুদ্ধেও অপহরণের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি হচ্ছেন পুলিশের কনস্টেবল এবাদুর রহমান। তিনি সিলেটে গত বছর আবু সাঈদ নামে নয় বছরের এক শিশুকে অপহরণ করে তার পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করেন। মুক্তিপণ পেয়েও তিনি আবু সাঈদকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। একজন পুলিশ সদস্য যদি এ ধরনের অপরাধ করেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কার কাছে নিরাপত্তা চাইবে? কেন এই নির্মমতা? কেন এই পাশবিকতা? অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা কিংবা বিচারে ধীরগতির সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের প্রসারের কারণে ঘটছে এ ধরনের ঘটনা।

এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি একজন মানুষের অপরাধী হয়ে ওঠাও ঠেকাতে হবে। পরিবার থেকে শিশুকে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। সন্তান কাদের সাথে মিশছে, তা দেখতে হবে বাবা-মাকে। তাহলে হয়তো কমতে পারে এই অপরাধপ্রবণতা। পক্ষান্তরে শিশু অপহরণ ও হত্যার পর অপরাধীদের তেমন কিছুই হয় না ধারণাও মিথ্যা প্রমাণে আইন প্রয়োগে অনমনীয় হতে হবে। চুয়াডাঙ্গা ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র সজিব অপহরণ ও হত্যাকারীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কাম্য।