অহিংস মহামানবকে হারিয়ে শোকাহত আমরা

‘কালো আর ধলা বা শাদা যে যাই হোক ভেতরটা কিন্তু সকলেরই সমান। কান্না হাসি? অনুভূতি? তিনি শিখিয়েছেন ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান রাঙা’। যাকে হারালাম আমরা, তিনি  নেলসন ম্যান্ডেলা। যিনি শুধু আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কিংবদন্তী নেতাই নন, বিশ্বের হিংসা-উন্মত্ত স্রোতের বিপরীতে সবচেয়ে শক্তিশালী বাঁধ হয়ে আগলে ছিলেন বিশ্ববাসীকে। ‘হিংসায় উন্মত্ত, নিষ্ঠুর দ্বন্দ্ব’ বিশ্ব যখন হতাশার চোরা স্রোতে ভাসছে তখনও ম্যান্ডেলার জীবন-কর্ম ও দর্শন সেই হতাশদীর্ণ মনে জুগিয়েছে আশার আলো। দিয়েছে স্বস্তি। শক্তির জোগান দিয়েছেন আফ্রিকার এ মহামানব। বর্ণবাদের বিষাক্ত কারাপাঁচিল ভেঙে তিনিই যে সর্বমানব মুক্তির জয়গান গেয়েছিলেন। পর্বতসমান প্রতিকূলতার স্রোত ঠেলে তার আহ্বান, তার শান্তির বাণী পৃথিবী যতোদিন থাকবে ততোদিন শান্তিকামীদের স্বস্তির পথে হাঁটতে সাহস জোগাবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নাগপাশ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় যুগে যুগে দানা বেধেছে কতো আন্দোলন। যেই স্বপ্নে পৃথিবীবাসী বুঁদ হতো নতুন দিনের জন্য, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হারিয়ে যেতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরই সাজানো অন্ধগলিতে। নেলসন ম্যান্ডেলা পথ হারাননি। তিনিই পথ দেখিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে তার মতো এমন সার্থক স্বপ্নপুরুষ জগতে ক’জন আছে? ২৭ বছর কেন, আরও শত বছর কারাগারে কাটলেও টলতেন না ‘অহিংসার’ মূলমন্ত্র থেকে। সশ্রম কারাদণ্ডের অংশ হিসেবে একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সময়ও ম্যান্ডেলা কারা-অন্তরীণে বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। সামান্য খাদ্য এবং সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত রাজবন্দী হিসেবে তিনি জানতেন না কতো বছর পার হলে ঊষার আলো প্রবেশ করবে তার কারাকুঠরিতে। এক সময় এ নিরন্তর অহিংস সংগ্রাম ও অতিসংযমী ধৈর্যের ফসল ফলে ওঠে ম্যান্ডেলার আঙিনায়। তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক, গণতন্ত্র-স্বাধীনতার-সৃজনশীলতা ও ধৈর্যের প্রতীক। ম্যান্ডেলা মনে করতেন, ‘এ পৃথিবীকে যে রকম দেখছি, তোমাকে তাই মেনে নিতে হবে এমন কোনো কথা নয়। আমাদের কাজ হবে, আমরা যেভাবে (মানবিক) পৃথিবী চাই, তা খুঁজে নাও। এ উক্তি প্রমাণ করে তিনি  শুধু কালো মানুষের মুক্তি নয়, সব মানুষেরই মুক্তিকামী ছিলেন। চলতি বছরের জুনের শেষ দিকে ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে বারবার হাসপাতালে ভর্তি হন ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। ১ সেপ্টেম্বর বাড়ি ফেরার পর নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন। গত ৫ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন জনদরদী এ নেতা।

 

কীভাবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানালে এ ‘অহিংস’ মহামানবের জন্য যথার্থ হবে-তা নিরূপণ কঠিন। শুধু নেলসন ম্যান্ডেলার মহাপ্রয়াণে, প্রস্থানে আমরা বিষণ্ণ, শোকাহত।