অস্বস্থির জন্ম হওয়াও অমূলক নয়

অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করছে সরকার-এমন অভিযোগ তুলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। ঢাকা ফোরাম আয়োজিত ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও গণতন্ত্র’ শীর্ষক এক আলোচনাসভায় দেশের বিশিষ্টজনেরা এ মন্তব্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসির কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশে নির্বাচনের যে প্রস্তুতি ও পরিবেশ, তাতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো আশার আলো তারা দেখছেন না- আলোচনাসভায় সারমর্মও এমনটি। তারা মনে করেন, দেশের স্বার্থেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রয়োজন। দেশের বিদ্যামান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা সাপেক্ষে বিশেষজ্ঞদের এই মন্তব্য সাধারণ মানুষের মনে অস্বন্তির জন্ম হওয়াও অমূলক নয়। বিষয়টি একই সাথে উদ্বেগেরও।
বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্রের চর্চা নানাভাবেই আলোচনায় আসে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা নেই, বিশেষজ্ঞদের এমন মন্তব্য প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখা যায়। আবার রাজনীতিকরা নিজেদের গণতন্ত্রী দাবি করলেও তারা মূলত দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থের জন্য রাজনীতি করছেন- তাদের বক্তব্য-বিবৃতিগুলো পর্যালোচনা করলে এমন চিত্রও ওঠে আসা অস্বাভাবিক নয়। রাজনীতিকরা কি এদেশে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম, রক্তপাতের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন- সঙ্গত কারণে এমন প্রশ্ন অবান্তর হতে পারে না। শনিবার অনুষ্ঠিত ওই আলোচনাসভার সূত্রে অস্বীকার করা যায় না যে, ‘একদল নির্বাচনের প্রচার শুরু করেছে, আর অন্যদল বন্দি।’ তাহলে এদেশে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কীভাবে সম্ভব হবে- সেটা অবশ্যই ভাবনার বিষয়।
বক্তারা বলেছেন, সংসদ ভেঙে নির্বাচন দেয়া ও নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয় আমলে নেয়া হচ্ছে না। অথচ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে শাসকদল এবং ইসি তাদের ওপর যে সাংবিধানিক দায়িত্ব তা এড়িয়ে যেতে পারে না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা দরকার, তা তাদেরই করা উচিত। প্রয়োজনে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে বিশিষ্টজনেরা মনে করেন। দেশে অতীতের নানা নির্বাচন ও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন-পরবর্তী কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট যে,সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ব্যতিরেকে এদেশের কোনো নির্বাচন ব্যাপকভাবে গৃহীত ও নন্দিত হবে না। দেশের রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে এবং ‘সংবিধানের অজুহাত দিয়ে সরকার একদলীয় শাসনের পথ বেছে নিয়েছে’ বলে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা খণ্ডানোর জন্য হলেও সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া।
বিশেষজ্ঞদের কথায় স্পষ্ট যে, দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা না হলে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমরাও বারবার এমন কথা বলে আসছি। আমরা মনে করি, রাজনীতি যেহেতু জনকল্যাণের উদ্দেশে পরিচালিত সুতরাং জনগণের কল্যাণ সাধনের জন্যই দলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের স্বার্থে কাজ করা জরুরি। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের সমালোচনা করতেই পারে, এতে অবাক হওয়ার মতো কিছুই থাকে না। কিন্তু যখন দেশের বিশিষ্টজনেরা সরকারের সমালোচনা করেন তখন সরকারের নিজেদের অভ্যন্তরীণ ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ থাকে বলেই প্রতীয়মান হয়। অপরদিকে, নির্বাচন কমিশনেরও এমন উদ্যোগ নেয়া জরুরি, যাতে তাদের ওপর জনআস্থার ঘাটতি তৈরি না হয়।
আলোচনা সভায় অভিযোগ উঠেছে,বর্তমান নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম নয়। ক্ষমতাসীন দলের সুবিধামতোই চলছে ওই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। একটি গণতন্ত্রকামী রাষ্ট্রে এমনটি কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। দেশের স্বাধীনতার চেতনা, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করতে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের যে তাগিদ বিশিষ্টজনেরা দিয়েছেন তা দেশবাসীর মনের কথা বললেও বোধ করি অতুযক্তি হয় না। বিশিষ্টজনের এ তাগিদকে সমর্থন জানিয়ে আমরা মনে করি, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। সুতরাং আলোচনা সভায় উঠে আসা সুপারিশগুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকার এ ব্যাপারে আরও আন্তরিক হবে।