অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সমাজকে যে শিক্ষা দিয়ে গেলো

কতোটা কষ্ট নিয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আল আমিন আত্মঘাতী হয়েছে তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। আত্মহত্যার আড়ালে লুকিয়ে অর্থাভাবে লেখাপড়া করতে না পারার যন্ত্রণা। যে দেশে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তকসহ বিদ্যালয়ের বেতন যতসামান্য, সে দেশে অভাবের কারণে লেখাপড়া করতে না পারার কষ্ট কেন? প্রসঙ্গক্রমেই উঠে এসেছে মাধ্যমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই জারি করা নীতিমালা বা সার্কুলারের এক ধারাবলে বিদ্যালয়ে কোচিং তথা অতিরিক্ত পাঠদানের ব্যবস্থা করে দাবি করা অর্থ। যদিও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ দাবি সঠিক নয় বলে জানিয়ে বলেছেন, নির্ধারিত ৪শ টাকা নয়, মাত্র ১শ টাকা নেয়া হয়েছে। তাও স্বেচ্ছায় দিয়েছেন আল আমিনের মা। ঘটনার আড়ালে পারিবারিক ঘটনা বলেই প্রতীয়মান মন্তব্য প্রধান শিক্ষকের।

আল আমিন চুয়াডাঙ্গার সরোজগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র ছিলো। বিদ্যালয়ের ৭ম, ৮ম ও ১০ম শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীকেই বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিষয়ভিত্তিক দেড়শ টাকা করে হলে মোট ১৯শ ৫০ টাকা হওয়ার কথা। তা না নিয়ে শিক্ষার্থী প্রতি ৪শ টাকা করে নিয়ে অতিরিক্ত পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে কোনো কোনো ছাত্রছাত্রীর নিকট থেকে কমও নেয়া হয়। আল আমিনের নিকট থেকে গত বছরে যখন ৭ম শ্রেণিতে ছিলো তখন ১শ টাকা করে নেয়া হয়েছে। ৮ম শ্রেণির অতিরিক্ত পড়ানোর ফিস বাবদ ঘটনার পূর্বদিন তার মা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে ১শ টাকা স্বেচ্ছায় দেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লিখিতভাবেই এ কথা স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রেও কি প্রশ্ন উঠতে পারে না? মাসে মাসে ১শ টাকা করে দেয়াও ওর দরিদ্র দিনমজুর পিতার পক্ষে অসম্ভব! সে কারণেই লেখাপড়া বন্ধের জন্য নাকি তার পিতা দীর্ঘদিন ধরেই তাকে বলে আসছিলেন। বিষয়টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কখন শুনেছেন? সম্ভবত আল আমিন যখন আর বেঁচে নেই।

বিদ্যালয়ের কোচিং বা অতিরিক্ত পড়ানো কেন? যুক্তি- পিছিয়ে পড়া কিছু শিক্ষার্থীকে পিছিয়ে পড়া বিষয়ে অতিরিক্ত পড়ানোর ব্যবস্থা করা যাবে। যদি অভিভাবক আবেদন করেন। আল আমিনের ক্ষেত্রে কি তার অভিভাক এ আবেদন করেছিলেন? হ্যাঁ বা না। তা ছাড়া একটি বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট তিনটি শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীকে সকল বিষয়ে অতিরিক্ত পড়ানো হচ্ছে কেন? তা হলে কি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে আন্তরিকতার অভাব? তা না হলে সকল শিক্ষার্থীকেই সকল বিষয়ে অতিরিক্ত পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে কেন? মন্ত্রণালয়ের সার্কুলারে কি কোন শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীকে সকল বিষয়ে অতিরিক্ত পড়ানোর কথা বলা হয়েছে? তা যখন নয়, তখন কেন বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি ঢালাও কোচিঙের অনুমোদন করলো? শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের জন্য বেতন দেয়া হয়। সে বেতন কি শিক্ষকরা নিচ্ছেন না? নিচ্ছেন। তা হলে সকল শিক্ষার্থীই কেন সকল বিষয়ে পিছিয়ে? পিছিয়ে পড়ার অজুহাতে অতিরিক্ত পড়ানোর সুযোগ পেয়ে অতিরিক্ত আয়োজন করে অতিরিক্ত আয় কতোটা যুক্তিযুক্ত? এ জন্যই ওই সার্কুলার দেশের শিক্ষানুরাগীদের মাঝে ব্যাপক সমালোচিত।

শিশু শিক্ষার্থী আল আমিন আত্মঘাতী হয়ে সমাজকে যে শিক্ষা দিয়ে গেছে, তা থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার। অবশ্যই সকল শিক্ষার্থীর অভিভাবক আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অনেক পিতা-মাতাই তার সন্তানকে লেখাপড়া করতে না দিয়ে অকালেই কাজে লাগিয়ে দেন। মূলত এ কারণেই প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার আশাতীতভাবে হ্রাস করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও বর্তমান সরকার শিক্ষার আলোয় গোটা দেশকে আলাকিত করতে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যপুস্তক দেয়ার পাশাপাশি নানামুখি কর্মসূচি হাতে নিয়ে সফলভাবে বাস্তবায়ন করে চলেছে। নীতিমালার কিছু দুর্বলতা বা ত্রুটি যদি বিদ্যালয়কেই বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপান্তর করতে সহায়ক হয় তা হলে তা দ্রুত সংশোধন করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি জরুরি।