অবৈধচালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি

বিশ্বের সব দেশেই কমবেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সড়ক দুর্ঘটনা মানেই বীভৎস মৃত্যুর খেলা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটে থাকে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। আর এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মূলত অবৈধ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং সড়ক-মহাসড়কের ভঙ্গুর অবস্থা, যা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জরিপে ইতঃপূর্বে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি সহযোগী কয়েকটি দৈনিকের প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত যে তথ্য এসেছে তা উদ্বেগজনক বললেও কিছুটা কম বলা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের পৌনে ৭ লাখ গাড়ি চালাচ্ছেন অবৈধ চালক আর ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছে সোয়া তিন লাখ। দেশের সড়ক নিরাপত্তার জন্য এ পরিস্থিতি যে কতোটা ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোকে মৃত্যুফাঁদ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে অনেক আগেই। পরিতাপের বিষয় যে, সড়ক-মহাসড়কে ঘটে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর ৯১ ভাগের জন্য চালকের অসতর্কতা, অদক্ষতা ও বেপরোয়া মানসিকতা দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। আবার প্রায় সমভাবে দায়ী সড়কে চলাচলকারী ত্রুটিপূর্ণ বা ফিটনেসবিহীন যানবাহন। দেশের বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেও একই ভয়ঙ্কর চিত্রের দেখা মেলে। কিন্তু বাস্তবতা যে, সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষকেই এসবের প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না। সড়কপথে প্রতিনিয়ত একের পর এক মৃত্যুর ভয়াবহতা দেখা গেলেও কোনো পক্ষেরই এ ব্যাপারে যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই। যদিও সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহন ও চালকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের এ উদ্বেগজনক বাস্তবতা নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। এরপরও বিদ্যমান অবস্থার অর্থবহ কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না। তবে আশার কথা যে, সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী অবৈধ চালক ও যানবাহনের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যা আজ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। সরকারের এ ‌বিশেষ অভিযানকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবেই দেখতে চাই। তবে তা কতোটুকু ফলপ্রসূ হবে, সে প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।

বিআরটিএর তথ্য মতে, ২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ডিজিটাল স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত ৬ লাখেরও বেশি চালককে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এরপরও জাল লাইসেন্স নিয়ে বা লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা যে থেমেছে তা বলা যায় না। অভিযোগ রয়েছে, সড়ক পরিবহন শ্রমিক সমিতিগুলোর নেতারা প্রতিবছর পরীক্ষা ছাড়াই চালকদের লাইসেন্স দিয়ে থাকে। আবার পরিবহন শ্রমিক সমিতি ও ইউনিয়ন নেতারা বিআরটিএকে চাপ দিয়ে এক যুগে ৪ লাখ চালকের কোনো রকম পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স দিতে বাধ্য করেছে। সঙ্গত কারণে, সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ যে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ হয়ে রয়েছে আমাদের সে আশঙ্কাও অমূলক মনে হয় না। কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেতাদের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের এ নতজানু নীতি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিআরটিএ কেন মেরুদণ্ডহীন তা আমাদের মাথায় ঢোকে না। অর্থাৎ সবকিছু মিলে এ খাতের যে পরিস্থিতি তা কিছুতেই স্বস্তিকর নয়। ফলে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বার্থে এসব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট বিভাগকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, নগরীতে প্রায় প্রতিদিনই ট্রাফিক পুলিশ লাইসেন্সবিহীন বা জাল লাইসেন্সধারী চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। গড়ে আড়াই থেকে ৩ হাজার মামলাও হচ্ছে প্রতিদিন। তবু এ ভয়াবহ প্রবণতা কমছে না। দেশের পরিবহন খাতের সামগ্রিক এ চিত্র মোটেও স্বাভাবিক নয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যানবাহন নিবন্ধন, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান ইত্যাদি বাস্তবসম্মত সরকারি পদক্ষেপের কারণে এ খাতের আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন ঘটেছে। আমরা মনে করি নিশ্চিতভাবে এ খাতে আরো উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। অনস্বীকার্য যে, এক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা কঠিন বাধা হচ্ছে, দুর্নীতি ও অনিয়ম। আমাদের প্রত্যাশা বিশেষ অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি এ খাতের দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে সরকার কঠোর হবে। এর পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে নিতে হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। সরকার আন্তরিক হলে নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠা এবং এ খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা মোটেও অসম্ভব নয়।