অপারগতায় আত্মসমর্পণের চিত্রটাই ফুটে উঠছে ক্রমাগত

 

তরুণ-তরুণীদের সবসময়ই ঝোঁক নতুনের দিকে। সে রঙেই হোক, আর ঢঙেই হোক। এ সুযোগটাকেই মূলত কাজে লাগিয়ে ফ্যাশন টেন্ডে তথা ঢঙের প্রবণতায় নতুনত্ব এনে নানাভাবে নতুনদের সামনে মেলে ধরেন নকশাকারকরা। দায়িত্বের অংশ হিসেবেই নতুনত্ব আনতে মেধা প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটিয়ে সফলতা পাওয়ার ভাবনায় বিভোর থাকেন। নতুনদের আকৃষ্ট করতে পারাটাই তাদের সফলতা। আড়ালে থাকে ব্যবসায়ীদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তা না হলে ওইসব পোশাকের দাম অতো হবে কেন? কেনই বা সমাজের সর্বস্তরে তার এতো প্রভাব। ধনী পরিবারের তরুণদের তা পেতে শুধু ইচ্ছে প্রকাশ করলেই হয়, আর নিম্নবিত্ত পরিবারের কর্তারা তাদের সন্তানদের আবদার মেটাতে গিয়ে নাকানিচুবানি খান। দরিদ্র পরিবারের পিতাকে? সন্তানের আবদার মেটাতে না পারার কষ্ট যে কতোটা তীব্র তা অর্থশালীরা অনুভব করবেন কীভাবে? আগ্রাসী অপসংস্কৃতি এ কষ্ট বাড়িয়ে চলেছে ক্রমশ।

ইচ্ছে করলেই পুরোনোকে আকড়ে ধরে পড়ে থাকা যায় না। মানবসভ্যতার ইতিহাসের পরতে পরতে পরিবর্তনের জোয়ার। তারই অংশ গতবারের পাখি ফ্রোগের বদলে এবার কিরণমালা, কটকটি। যদিও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চায় চরম ব্যর্থতার কারণেই প্রতিবেশী দেশের বেসরকারি বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম নানাভাবেই বদলে দিচ্ছে রুচি। বিশেষ করে তরুণীদের পোশাকের ক্ষেত্রে পড়শি দেশের প্রভাব অনেকটাই আগ্রাসী। রাক্ষুসি বললেও বোধ করি বেশি বলা হয় না। কেননা, নাটকে যে কটকটি চরিত্র রাক্ষস সাম্রাজ্যের অধিপতি, সেই কটকটির পোশাকও আকৃষ্ট করবে ভেবেই ওই নামে বাজারে পোশাক ছেড়েছে ব্যবসায়ীরা। আর সেদিকেই ঝোঁকার প্রবণতা ক্রমশ লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। দৃশ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে হয়, হায়রে ঢঙ বদলানো ঝড়োবাতাস!

মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল-কুফল দুটোই আছে। আকাশ সংস্কৃতি বাধমুক্ত করারও ভালো-মন্দ নিয়ে বিতর্ক আছে। পড়শি দেশের আকাশ সংস্কৃতি বাধমুক্ত করে দেয়ার পাশাপাশি নিজেদেরটাও যদি সেখানে অবাধে প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতো তা হলে প্রতিযোগিতা জমতো ভালো। ওদের সংস্কৃতি অবাধে যেভাবে ঢেলে দিচ্ছে সেভাবে আমাদেরটাও ঢুকিয়ে দেয়ার মতো দক্ষতা বৃদ্ধির মানসিকতা গড়ে উঠতো। তা হচ্ছে না। একতরফাভাবে পড়শি দেশের বেসরকারি গণমাধ্যমগুলো আমাদের অন্দরমহলে ঢুকে যা ইচ্ছে যেন তাই-ই করছে। চলনেবলনে, রঙেঢঙের যে বীজ আমাদের নারী তরুণীদের মজ্জায় বপন করছে, তারই ফসল হিসেবে পোশাকের বাজার দখল নয় কি? যেহেতু আমরা আমাদের গণমাধ্যমগুলোয় ওইভাবে প্রভাব ফেলতে পারছি না, সেহেতু অপারগতায় আত্মসমর্পণের চিত্রটাই ফুটে উঠছে ক্রমাগত।

‘দেশি পণ্য কিনে হোন ধন্য’ এ স্লোগান তখনই পূর্ণসফলতা পায় যখন জাগ্রত দেশত্ববোধ আর বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব হয়। নতুনদের আকৃষ্ট করতে শালিনতা রেখে নতুনত্ব আনতে দরকার গবেষণা, মেধা-প্রজ্ঞার প্রতিফলন। রঙেঢঙের প্রবণতায় নিজস্ব আভিজাত্য, রুচিশীলতা ধরে রাখতেও প্রয়োজন সুস্থ ধারার সংস্কৃতিচর্চা। তাতে শূন্যতা বা ঘাটতি দেখা দিলে অন্য সংস্কৃতি ঝড়ের মতোই ছুটে এসে দখল করে। রুখতে দেশের গণমাধ্যমগুলোই পারে অগ্রণীভূমিকা রাখতে। যারা পড়শি দেশের চটকদার সংলাপ আর ক্যামেরার কারুকার্যসহ অভিনয়ের শৈল্পিক উপস্থাপনে ঘোরানো প্যাঁচানো গল্পে আকৃষ্ট হয়ে বিভোর, তাদের জাগিয়ে ঘরের দিকে চোখ ফেরানোর দায়িত্ব গণমাধ্যমেরই। মনে রাখা দরকার, দেশত্ববোধ জাগিয়ে তুলে অপসংস্কৃতি রুখতে না পারার ব্যর্থতা দেশের সৃজনশীল বুদ্ধিজীবী বলে দাবিদারদের ওপরই বর্তায়।