অন্যায়ের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে

 

চুয়াডাঙ্গায় স্বাস্থ্যসেবার নামে এসব কী হচ্ছে? প্রশ্নটি দায়িত্বশীল চিকিৎসকদের বিব্রত করলেও তারা নিশ্চয় অস্বীকার করতে পারবেন না যে, স্বাস্থ্য প্রশাসন নখবিহীন বাঘে রূপান্তর হওয়ার কারণেই অনিয়ম দিন দিন বেড়ে চলেছে। অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের পর আয়ার পুশ করা ইনজেকশনের পরপরই ফুটফুটে কিশোরীর মৃত্যু, সময় হওয়ার আগেই সিজার করার কারণে অপূর্ণ নবজাতকের প্রাণহানির পরও দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। অথচ তাদের অপরাধ হত্যার মতোই গুরুতর। সর্বশেষ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরুষের আল্ট্রাসনো রিপোর্টে চিকিৎসক লিখেছেন, ৪ মাসের সন্তান গর্ভে মারা গেছে। অবশ্য পরে ভুল স্বীকার করে সুধরে নিয়েছেন ডা. খবির উদ্দীন। তিনি এতোই ব্যস্ত যে, কার আল্ট্রাসনো রিপোর্টে কী লিখছেন তা দেখার মতো সময় নেই। তার ব্যস্ততার কারণে একজন রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে, এটা ভুলে না গেলে ওরকম ভুল হয় কীভাবে? এসবের পরও কি বলতে হবে, চুয়াডাঙ্গায় স্বাস্থ্যসেবার নামে যা চলছে তা মেনে নেয়ার মতো?

চুয়াডাঙ্গায় যতোগুলো ক্লিনিক নার্সিং হোম রয়েছে তার সবই কি অনুমোদিত? অনুমোদন ছাড়া যেসব ক্লিনিক নার্সিং হোমে কারা চিকিৎসা দিচ্ছেন, কীভাবে চলছে এসব? তা দেখার দায়িত্ব অবশ্যই জেলার স্বাস্থ্য প্রশাসনের। অভিযোগ রয়েছে, অদৃশ্য কারণে স্বাস্থ্য প্রশাসন এসব ক্লিনিক বা নার্সিং হোমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাদের অপকর্মকেও নীরবে মেনে নিচ্ছে। তা না হলে গত ১৭ মে সকালে চুয়াডাঙ্গা ভালাইপুরের সাইনবোর্ডবিহীন ক্লিনিকে কিশোরী মহুয়াকে মরতে হলো কেন? পেটে ব্যথার কারণে তাকে ওই ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয়। ভোরে অপারেশন করার পর ক্লিনিকের আয়া ইনজেকশন দেন। সাথে সাথে কিশোরী মহুয়া মারা যায়। ক্লিনিক বা নার্সিং হোমে যখন ডিপ্লোমাধারী নার্স রাখা বাধ্যতামূলক, তখন একজন আয়া ইনজেকশন দিলেন কেন? ভুল ইনজেকশনের কারণে কিশোরীর মৃত্যু হলে কেন আয়া এবং ওই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা হলো না? অপারেশনে ত্রু টি ছিলো কি-না তাও তো খতিয়ে দেখার ন্যূনতম উদ্যোগ নেয়া হলো না। এরপরও কি দাবি করা যায়, যে স্বাস্থ্য প্রশাসন সক্রিয়? না। সক্রিয় থাকলে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের অদূরবর্তী মা ক্লিনিকে নির্ধারিত সময়ের আগেই অপারেশনের কারণে নবজাতকের মৃত্যুর খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশের সাথে সাথে স্বাস্থ্য প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে আন্তরিক হতো। হয়নি। হচ্ছে না বলেই আল্ট্রাসনো রিপোর্টেও পুরুষের পেটে ৪ মাসের সন্তান মারা যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। আর রক্তের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অধিকংশে যা হচ্ছে তা তো লিখে শেষ করার মতো নয়। এভাবে চলতে থাকলে স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা থাকবে না। থাকছেও না। আস্থা তলানিতে ঠেকেছে বলেই তো চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। দেশে চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে না পারলে একদিন দেশের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো রোগীশূন্য হয়ে পড়বে বললে ভুল বলা হয় না।

শুধু বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলোতেই অনিয়ম নয়, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোরও বেহাল দশা। চিকিৎসকদের অধিকাংশেরই ঝোঁক ক্লিনিক নার্সিং হোমগুলোর দিকে। কারণ, বাড়তি আয়। এছাড়া বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিশেষ উপঢৌকনে নিম্নমানের ওষুধ লেখারও ক্ষতিকর রেওয়াজ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে ওষুধের জেনিটিক নাম লেখার দাবি আর অযৌক্তিক থাকছে না। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক বা নার্সিং হোমগুলোকে সরকারি বিধিবিধান মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ দায়িত্ব অবশ্যই স্বাস্থ্য প্রশাসনের। স্বাস্থ্য প্রশাসন যদি নীরব ও কুম্ভঘুমে আছন্ন থাকে, তা হলে দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়বে কীভাবে? স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধির জন্য অবশ্যই সকল চিকিৎসককে জবাবদিহিতার মধ্যে নিতে হবে। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসহ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকেও যথাযথভাবে নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করা উচিত। ভুল স্বীকার করলেই নমনীয় দৃষ্টিতে দেখার চেয়ে আর ভুল হবে না, ভুল করবে না তা নিশ্চিত করতে হবে। একজন অন্যায় করে পার পেয়ে গেলে সমাজের অন্যদের মধ্যেও অভিন্ন অন্যায়ের প্রবণতা ছড়ায় বৈকি।