হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অতি পরিচিত নীলকানখয়রাপাখ ও লাল মাছরাঙ্গা পাখি

 

 

রহমান মুকুল: বর্ষায়ও এখন আর দেখা মেলেনা আমাদের অতি চেনা নীলকান,খয়রাপাখ ও লাল মাছরাঙ্গা পাখি। এ ৩ প্রজাতির পাখি এক সময় আমাদের চারপাশের নদ-নদী, খালবিল,হাওড়-বাওড়ের সর্বত্র দেখা মিলতো। চিরচেনা এ দৃশ্য এখন অতি বিরল। সাধারণত এখন আর দেখা মেলা ভার এ মাছরাঙ্গার প্রজাতিগুলোর।

নীলকান মাছরাঙা: সাধারণত নীলকানের জন্য মাছরাঙ্গার এ প্রজাতিটির নীলকান মাছরাঙা নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। বাদামি চোখ ও নীল কান-ঢাকনি পড়া মাছ শিকারি এরা। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ ঘন নীল ও দেহতল গাঢ় কমলা রঙের।গালের চারিপাশ, ঘাড় ও ডানা-ঢাকনি বেগুনে-নীল, পিঠের নিচ থেকে লেজ বরাবর নীলের মোটা রেখা নেমে গেছে। গলা ও ঘাড়ের পাশে শাদাপট্টি, উজ্জ্বল নীল চোখ বাদামি পা, পায়ের পাতা ও নখর কমলা রঙের। ঠোঁট দু রঙের। ওপরের অংশ কালচে বা কালচে বাদামি ও ঠোঁটের নিচের অংশে কমলা সংযোগস্থল ও মুখসহ বাদামি-কমলা। চিরসবুজ বনবাদাড়ের পাশের নদ-নদী,খাল-বিলে সাধারণত একা বা জোড়ায় থাকতে দেখা যায়। পানির ওপরে ঝুলন্ত ডালে এরা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে এবং সুযোগ এলে শিকার ধরার জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদের খাদ্যতালিকা বেশি দীর্ঘ নয়। মাছ ও জলজ পোকামাকড়। শিকারের অপেক্ষায় থাকার সময় এরা ঘন ঘন মাথা ওঠায় আর নামায় এবং লেজ খাড়া করে রাখে। তীব্র কণ্ঠে এরা ডাকে চিচি…চিচি..রবে।

খয়রাপাখ মাছরাঙা: এক সময়ের এ অতি পরিচিত খয়রাপাখ মাছরাঙা পাখিটিরও এখন দেখামেলা ভার। প্রকাণ্ড লাল ঠোঁট ও বাদামি ডানার মাছ শিকারি পাখি এটি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও ঘাড় বাদামি-কমলার মিশ্র কালারের। কাঁধ-ঢাকনি ও ডানা কালচে বাদামি, পিঠ ও কোমর নীল। প্রান্তের পালক ও ডানা বাকি অংশের চেয়ে গাঢ় বাদামি। গলা, বুক- পেট ও লেজের দিক একই রকম বাদামি-কমলা। এদের চোখ বাদামি ও চোখের পাতা ইট-লাল। পা ও পায়ের পাতা লাল, ঠোঁটের গোড়া থেকে চোখ পর্যন্ত কালচে বাদামি একটা রেখা টানা। একা বা জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। উঁচু ডাল থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে এরা শিকার ধরে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে কাকড়া, সরীসৃপ ও মাছ। ওড়ার সময় এরা পানির অল্প ওপর দিয়ে চলে, কিন্তু বসার আগে ওপরে উঠে উঁচু ডালের বসে। অনেক সময় করুণ সুরে শিস্ দিয়ে ডাকে- চৌ-চৌ-চৌ-..। খয়রাপাখ মাছরাঙার বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ কালোডানা সিন্ধুসারস।

লাল মাছরাঙা: লাল মাছরাঙা বনজঙ্গলে থাকতেই বেশি পছন্দ। সাধারণত লোকচক্ষুর অন্তরালে এদের বেশি বিচরণ ছিলো। লাল রঙের এ প্রজাতির মাছরাঙ্গা পাখির পিঠ লাল-কমলা ও দেহতল ফ্যাঁকাসে লাল। মাথায় দারুচিনি বা উজ্জ্বল লাল-তামাটে রঙ ও ঘাড়ে লাল বেগুনির অপরূপ সৌন্দর্য বিরাজমান। পিঠের নিচে ও পেছনে ফ্যাকাসে নীলের ওপর শাদার ফ্লেভার। কালচে গোড়া এবং ফ্যাকাসে বা পাটল বর্ণের আগাসমেত ঠোঁট লাল। চোখ কালচে বাদামি। পা ও পায়ের পাতা প্রবাল-লাল। এদেরকেও জোড়ায় ঘুরে দেখা যেত। পানির উপরিতল ও কাদায় শিকার খোঁজে এবং তারপর শিকার ধরার জন্য নিচে নেমে আসে এরা। এদের খাবার তালিকা কিছুটা দীর্ঘ। মাছ, কাঁকড়া, গুবরে পোকা, ফড়িং ও খুদে প্রাণী রয়েছে এদের খাদ্য তালিকায়। জোরে ও দ্রুত ডানা চালিয়ে তাড়াতাড়ি ও সোজা উড়ে চলে। সাধারণত তীব্র শব্দে কম্পিত সুরে ডাকে- টিটিটিটি.. এবং সুরেলা কণ্ঠে গান করে: কুয়িররর-র-র-র-র।

ঝুটিয়াল মাছরাঙা: এ প্রজাতির মাছরাঙ্গা পাখি এক সময় হামেশাই দেখা মিলতো। খুবই মনোহর দৃষ্টিনন্দন এ প্রজাতিটির এখন দেখা পাওয়াই দুস্কর। ঝুটিয়াল মাছরাঙা ডোরাওয়ালা ঝুটির মাল্টি কালার সত্যিই দৃষ্টি নন্দন। এ প্রজাতির মাছরাঙ্গা পাখির পিঠ নীল-ধূসর ও দেহতল শাদা। কালো দীর্ঘ কেশের ঝুটিতে কিছু শাদা স্টাইফ থাকে। গলাবন্ধ স্রেফ শাদা। সূক্ষ্ম শাদাফুটকি ও ডোরা সমেত পিঠ ও পেছন কালচে দেখায়। ডানা ও লেজে কালোর ওপর শাদা স্টাইপ থাকে। বগলে নিপুণ বাদামি ফুটকি ও বুকে কালো ফোটা এবং বগলে কালো ডোরা। কালো ঠোঁটের গোড়ার অর্ধেক ফ্যাকাসে ধূসর। চোখ কালো। পা ও পায়ের পাতা ধূসরাভ-জলপাই ও কালচে নখরের আগা শাদাটে।

ঝুটিয়াল মাছরাঙাদের জঙ্গলসংলগ্ন প্রবহমান জলাভূমি বেশি পছন্দ। এরা একটু বেশি নিভৃতচারী পাখি। এদেরকেও জোড়ায় থাকতে দেখা যেত। উপচে পড়া পানিতে হঠাত ডুব দিয়ে শিকার ধরে মাছ খায়। দ্রুত উড়েতে পারে। ধীরে ধীরে পাখা চালিয়ে প্রবহমান পানির কিছুটা ওপর দিয়ে উড়ে যায়। সাধারণত একটি মাত্র তীক্ষ্ণ শব্দে ডাকে- ক্লিক জাতীয় শব্দ করে। তা ছাড়া অবিরাম ডাকে অপেক্ষাকৃত নীচু গলায় পিঙ…শব্দে।ঝুটিয়াল মাছরাঙার বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ শোকাকূল পাখি।আমাদের চির পরিচিত প্রকৃতির এ সকল অনবদ্য সৌন্দর্য যাতে আর বিলুপ্ত হতে না পারে, সেজন্য এখনই পদক্ষেপ জরুরি।