লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারছে না ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ চিনিকল

৩১টি মসুমে ১২৪ কোটি টাকা লোকসান : অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম-দুর্নীতিই প্রধান কারণ

ঝিনাইদহ অফিস: ঝিনাইদহের একমাত্র ভারী শিল্প মোবারকগঞ্জ চিনিকল অব্যাহত লোকসানের শিকার হয়ে এখন বন্ধের উপক্রম হয়েছে। মিলটিতে বরাবরই আয়ের চেয়ে ব্যয় দেখানো হয়েছে অনেক বেশি। ফলে এখন দেনার দায়ে জর্জরিত অবস্থা এ প্রতিষ্ঠানটির। বিভিন্ন সেক্টরে সীমাহীন দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনাই প্রধান কারণ। ১৯৬৭-৬৮ অর্থবছরে মিলটি উৎপাদনে যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত লোকসান দিয়েছে ১২৪ কোটি টাকা। এ চিনিকলে এক কেজি চিনি উৎপাদনে ব্যয় হয় ৯০ টাকা। আর তা বিক্রি হয় ৫০ টাকায়। কেজি প্রতি লোকসান হচ্ছে ৪০ টাকা।

চিনিকলসূত্র জানায়, কালীগঞ্জ উপজেলা শহরের নলডাঙ্গায় ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ১শ ৮৯.৮১ একর নিজস্ব সম্পত্তির ওপর নেদারল্যান্ড পদ্ধতিতে সরকার মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি স্থাপন করে। এর মধ্যে ২০.৬১ একর জমিতে কারখানা, ৩৮.২২ একর জমিতে স্টাফদের জন্য আবাসিক কলোনী, ২৩.৯৮ একর জমিতে পুকুর ও প্রায় ১শ একর জমিতে পরীক্ষামূলক ইক্ষু খামার স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন মরসুমে পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ কর্মদিবস আখমাড়াই চলে এবং প্রথম মরসুমে ১ হাজার মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে ১০ হাজার মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছিলো। লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় পরবর্তী ১৯৬৭-৬৮ মাড়াই মরসুম থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চিনিকলটি উৎপাদন শুরু করে। সে মরসুমে ১৭ হাজার ৪শ ৪৪.০৯ মেট্রিকটন আখ মাড়াই করে ১২০০.৯০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়।

ঝিনাইদহের ৬টি উপজেলা ছাড়াও যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত হয় মোচিক জোন। জোনের আওতায় মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে সাড়ে তিন লাখ একর। এর মধ্যে আখচাষের উপযোগী জমির পরিমাণ ৬০ হাজার একর। এ জমিতে আখ চাষের লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয় চিনিকলটি। মোচিক জোনের আওতায় রয়েছে আরো ৮টি সাব জোন। এগুলো হলো কালীগঞ্জ মিলগেট-১, মিলগেট-২, ঝিনাইদহ সাব জোন, কোটচাঁদপুর সাব জোন, খালিশপুর সাব জোন, হরিণাকুণ্ডু সাব জোন, যশোর সাব জোন ও চৌগাছা সাব জোন। সাব জোনগুলোর আওতায় রয়েছে ৫৪টি ইক্ষু ক্রয় কেন্দ্র (সেন্টার)। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে মোচিক লক্ষ্যমাত্রার ধারের কাছেও পৌঁছুতে পারেনি। তবে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে মোচিকের এ রমরমা ভাব দেখে কৃষকেরা ঝুঁকে পড়েন আখচাষে। কিন্তু ধীরে ধীরে তা স্থিমিত হয়ে পড়ে। চাষিরা আখচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মোচিকের নিজস্ব ইক্ষু পরীক্ষামূলক খামারের প্রায় ১শ একর জমিতে মোচিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের তত্ত্বাবধানে আখচাষ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ জমিতে আখচাষ না করে কৃষকের কাছে ইজারা দিয়ে রেখেছে। মোচিকের নিজস্ব জমিতেও এখন অন্যান্য ফসলের চাষ করছেন কৃষক।

চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মিলের আখ ক্রয়ে ওজন পদ্ধতিতে জটিলতা, সরকার নির্ধারিত মূল্য কম, আখচাষের ক্ষেত্রে সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা না থাকা, বিক্রির টাকা সময়মতো কৃষকের হাতে না পৌঁছানোসহ বিভিন্ন কারণে চাষিরা আখচাষ থেকে পিছিয়ে আসতে শুরু করেছে।

মোচিক রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৯৬৭-৬৮ মরসুমে চিনিকলটি উৎপাদনে যায়। ওই বছর ১৭ হাজার ৪শ টন আখ মাড়াই করে ১২শ টন চিনি উৎপাদন করা হয়েছিলো। শুরুতেই লোকসান হয় মিলটির। সে বছর ২১ লাখ ৮১ হাজার টাকা লোকসান হয়েছিলো। পরপর ৫ বছর লোকসানের পর মিলটি লাভের মুখ দেখে ১৯৭৩-৭৪ মাড়াই মরসুমে। ওই মরসুমে  ৪৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা লাভ হয়েছিলো। পরবর্তীতে কোনো বছর লাভ, আবার কোনো বছর লোকসান হতে থাকে। সব মিলিয়ে লোকসানের পাল্লাই ভারি। ৪৬টি মাড়াই মরসুম বা চিনি উৎপাদন বছরের মধ্যে ৩১টি মরসুমে লোকসান হয়। ১৫টি মরসুমে লাভ করে মিলটি। লাভ হয় ৩৭ কোটি ৮৮ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ৩১টি মরসুমে লোকসান হয় ১২৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। বর্তমানে লোকসানের বোঝা রয়েছে একশ’ ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০০৬-০৭ মাড়াই মরসুম থেকে ক্রমাগত লোকসান হচ্ছে মিলটির। ১২৪ কোটি টাকার লোকসানের বোঝা মাথায় রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটির। মোচিকে প্রায় ১২শ শ্রমিক ও শতাধিক কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। তাদের মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের প্রদেয় অর্থ লোকসান অঙ্কের একটি বড় অংশ।

এদিকে চিনিকলে সাংবাদিকতার নামে কতিপয় ব্যক্তি অবৈধভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে। ওই সকল ব্যক্তিদের হুমকির মুখে তটস্থ থাকে চিনিকলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এতে করে প্রকৃত সংবাদকর্মীরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে সেখানে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনিয়ম দুর্নীতি, দক্ষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অভাব, নিম্নমানের সরঞ্জাম ক্রয়, কর্মচারীদের কাজে ফাঁকি, জোনের বাইরের আখ ক্রয়, কৃষকের কাছ থেকে আখ নিয়ে দু-তিন দিন সেন্টারে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখায় শুকিয়ে ওজন ও রস কমে যাওয়া। দক্ষ শ্রমিক ও নিম্নমানের যন্ত্রাংশে চিনি রিকোভারি কম হওয়াসহ একাধিক কারণে দিনে দিনে লোকসানে পড়ছে মোচিক। এর মধ্যে সব থেকে বড় কারণটি হলো পর্যাপ্ত আখ উৎপাদন না হওয়া। ১৯৮৩-৮৪ মাড়াই মরসুমে ১৭ হাজার একর পরিমাণ জমিতে আখচাষ করে মোচিক সাড়ে ৫ কোটি টাকারও বেশি লাভ করেছিলো। সে হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৬০ হাজার একর জমিতে আখ উৎপাদন সম্ভব হলে প্রতি বছর অন্তত ৪০ কোটি টাকা লাভ হবে।

চিনিকলের একটি সূত্র জানায়, উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় চিনির বিক্রয়মূল্য কম নির্ধারণ, চিনিকল জোন এলাকায় লাগামহীন গুড় উৎপাদনের কারণে মিলে প্রয়োজনীয় আখ সরবরাহের অভাব, অতীতে মিলে অতিরিক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভার টাইমের ঘাপলা, কৃষকদের মধ্যে পুঁজি বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতি, আখ বিক্রির টাকা পরিশোধে গড়িমসি সর্বোপরি বর্তমানে ধান-পাটসহ অন্যান্য ফসল চাষ তুলনামূলক লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা সেদিকে ঝুঁকে পড়ছে। ফলে আখচাষের জমির পরিমাণ কমে গেছে। প্রয়োজনীয় আখের অভাবে চিনিকল ক্রমাগত লোকসানের মুখে পড়ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিনিকলের একজন কর্মকর্তা জানান, জয়রায়ুগত সমস্যা, মিল জোন এলাকার আখচাষের গুণাবলীর সমস্যা, উন্নতজাতের আখচাষ না করা, মান্ধাতার আমলের চাষ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা উত্যাদি কারণে আখের ফলন আশানুরুপ হচ্ছে না। উপরন্তু উৎপাদিত আখ থেকে চিনি আহরণের হারও তুলনামূলক কম। এসব কারণে চিনিকলটি লাভজনক হতে পারেনি। মিলটি আধুনিকায়নসহ জমিতে আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ এবং উন্নতজাতের আখ ফলনের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন আনা সম্ভব।

চিনিকলের হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল অজিজ মল্লিক জানান, বর্তমানে মিলের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। এক কেজি চিনি উৎপাদনে ব্যয়  হয় ৯০ টাকা। সে চিনি ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। গত বছর ২২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা লোকসান হয়েছিলো। চলতি মাড়াই মরসুমেও ২০ কোটি টাকা লোকসান হবে বলে তিনি জানান। চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. দেলওয়ার হোসেন বলেন, ২০১২-১৩ মাড়াই মরসুমে এক লাখ ৪০ হাজার টন আখ মাড়াই করে ১০ হাজার ৫শ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিলো। এক লাখ ৩৩ হাজার ৭শ ৩৩ টন আখ মাড়াই করে ৯ হাজার ৪০ দশমিক ৪৩ টন চিনি উৎপাদন হয়েছে। চিনি রিকভারির হার হচ্ছে ৬ দশমিক ৭৫ ভাগ। একশ ৪ চার দিন মিল চালু রাখা সম্ভব হয়। তারপর আখের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এ বছরের উৎপাদিত ৫০ কোটি টাকা মূল্যের চিনি মজুত রয়েছে মিলের গুদামে। চিনি বিক্রি না হওয়ায় মিলটি অর্থ সঙ্কটে পড়েছে।

লোকসানের কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, মিলটি অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। প্রতি বছর মেরামত করে চালু রাখা হয়েছে। বছরে প্রায় দু কোটি টাকা মেরামতে খরচ হয়ে থাকে। বিএমআর করা প্রয়োজন। এতে অনেক টাকা ব্যয় হবে। চিনি রিকভারি কম হওয়াও লোকসানের আরেকটি কারণ। বেসরকারি রিফাইনারিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় পরছে না সরকারি চিনি কলগুলো। তারা পাইকারি ৪২-৪৩ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করছে। মিলের চিনির দাম কমিয়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকা করা হয়েছে। তাও বিক্রি হচ্ছে না। খোলা বাজারে খুচরা প্রতি কেজি চিনি ৪৭-৪৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মিলের ডিলাররা চিনি তুলছেন না। তিনি বলেন, চিনি শিল্পকে বাঁচাতে হলে অধিক চিনিযুক্ত ও স্বল্প সময়ে চাষ উপযোগী আখ উদ্ভাবন করতে হবে। যাতে চাষি লাভবান হয়ে আখচাষে উৎসাহী হবে। মিলও চিনির উৎপাদন বাড়াতে পারবে।