রাজকুমারী মেঘনার নাম মানুষ বিস্মৃত হলেও যমুনামাঠ নামের মধ্যে বেঁচে আছেন রাজকন্যা যমুনা

দাবি উঠেছে পাল যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারে নিয়মমাফিক খননকাজের

 

রহমান মুকুল: আলমডাঙ্গা- জামজামি সড়কের বিনোদপুর থেকে সোহাগপুর মাঠের অন্তরাটুকুই যমুনা মাঠ হিসেবে পরিচিত। যমুনা মাঠের বুক চিরে নিষ্ঠুর এ সড়কটি অতিক্রান্ত হয়েছে। দু পাশের বসতি যমুনা মাঠের শূন্যতা গ্রাস করে চলেছে। ফলে ধীরে ধীরে যমুনার অবয়ব ক্ষীণতর হচ্ছে। যমুনা মাঠের কথা মনে পড়লেই হাজারও নেতিবাচকতায় মন বিচলিত হয়ে ওঠে। বাস্তবতা এমনতর যে, যমুনার মাঠ আজ চুরি-ছিনতাই আর রাহাজানির সমার্থক হয়ে উঠেছে। এ সকল নেতিবাচকতা আড়াল করে রেখেছে রাজকুমারী মেঘনা-যমুনার লুব্ধক ইতিহাস। কী সেই ইতিহাস? যা আজ বিস্মৃত আমরা সকলেই। ‘সংখ্যা গণনার অতীত প্রত্যুষের’ না হলেও এ অনুদ্ধার ইতিহাসের বয়স নেহায়েত কম নয়। প্রায় ৮শ’ থেকে ১২শ’ বছরের পুরানো সে ইতিবৃত্ত। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণাদি না থাকলেও এ যমুনামাঠের আশপাশের জনপদে উপকথার মত ছড়িয়ে আছে, ছিটিয়ে আছে নানা কাহিনি-গল্প। এ গল্প-কাহিনির উদগাতারা সকলেই বর্ষিয়ান। গল্প-কাহিনির বয়ানকারীদের কিছু কিছু দাবি এই লোককাহিনি উন্মোচনের শত তমস্রার পথে নিহারিকার মত আলো জ্বেলে যায়। প্রলুব্ধ করে যায় নিরন্তর। তাদের বিশ্বাস ও বয়ানকৃত কাহিনি বক্ষমান নিবন্ধের উপজীব্য।

আনুমানিক হাজার বছর পূর্বের কথা (সাড়ে ৮শ থেকে সাড়ে ১২শ বছরের মধ্যে)। তখন বিনোদপুর, বাদেমাজু এ সকল গ্রামের অস্তিত্ব ছিলো না। হয়তো আশপাশের অনেক বসতিরই অস্তিত্ব ছিলো না। সবেমাত্র মাৎস্যন্যায় যুগের অবসান হয়েছে। ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে গোপাল পাল বৃহৎ বাংলার মসনদে বসেন। অনেকটা গণতান্ত্রিক উপায়ে। পালাক্রমে পাল বংশীয় রাজাদের শাসন প্রায় ৪শ’ বছর স্থায়ী হয়। শেষ পাল রাজা ছিলেন মদন পাল (১১৪৩–১১৬২ খ্রিস্টাব্দ)। গোপাল পালের সময়ই আমাদের অঞ্চল তার রাজ্যভুক্ত হয়। আমাদের বাংলার জমিন জুড়েই পালদের রাজত্বের গোড়াপত্তন এবং বিকাশ ঘটে। পাল শাসনামলের ৭৫৬ থেকে ১১৬২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যেকোনো সময় এই যমুনা মাঠে রাজা কানাই লাল পাল বসবাস শুরু করেন। প্রায় ৪ শতাধিক বছর শাসনামলে মোট ২১ জন পাল বংশীয় রাজা মসনদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তার মধ্যে কানাই লাল পাল বলে কারও নাম জানা যায় না। ধারণা করা হয়,  রাজা কানাই লাল পাল ছিলেন সামন্ত রাজা বা সামন্ত জমিদার। প্রমত্ত কুমার নদ বেষ্টিত এই ভূভাগে তিনি বসতি নির্মাণ করেছিলেন। তখন হয়তো যমুনার মাঠ কুমারনদ বেষ্টিত ছিলো। হয়তোবা কুমারনদ বেষ্টিত এই উঁচু সমভূমির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রাজা কানাই লাল পালকে মুগ্ধ করেছিলো। নদী বেষ্ঠিত এই এলাকার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই এখানেই বসতি গড়তে প্রলুব্ধ করে থাকতে পারে। এ বিস্তৃর্ণ মাঠের যে অংশে রাজা বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, এখনও সেই অংশকে স্থানীয়রা ‘কানাইডাঙ্গার মাঠ’ নামে অভিহিত করে আসছেন। এ মাঠের ভেতর দিয়ে জিকে প্রজেক্টের একটি সেকেন্ডারি খাল প্রবাহিত। প্রায় ১২ বছর আগে এ জিকে প্রজেক্টের ইরিগেশন খালের ওপাশে পুকুর খনন করার সময় রাজা কানাই লাল পালের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের অংশবিশেষ অথরা প্রাসাদের পাঁচিলের অংশবিশেষ পাওয়া যায় বলেই স্থানীয়দের দাবি। ডাউকী গ্রামের জান্নাত আলী নামের এক কৃষক পুকুরটি খনন করেছিলেন বলে জানা যায়। এখানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বৈশিষ্ট থেকে একজন প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানলব্ধ ব্যক্তি সহজেই বলতে পারবেন  ঠিক এই  নিদর্শনই পাল শাসনামলের কি-না।

এই মাঠ অবধি যে কুমারনদের আধিপত্য বিস্তৃত ছিলো তারও কম-বেশি বিলুপ্তপ্রায়  নিদর্শন এখনও রয়ে গেছে। মাঠের অনেকাংশ যে কুমারনদের গর্ভে ছিলো তার বহু স্বাক্ষর আজোবধি বিদ্যমান। এখনও এ বিশালাকার যমুনা মাঠের কিছু কিছু অংশের নাম নীরবেই সে সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। যেমন– বদনা দোয়া, বিলের দাড়ি, কালিপুকুর, পুকুরদোব, রামাদোহা ইত্যাদি।

ডাউকি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এক সময়ের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আব্দুল জব্বার বলেন, যমুনার মাঠে তাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমি ছিলো। বেশ কিছু জমি চাষ করা সম্ভব হতো না। বালিয়াড়ি ছিলো। সেখানে ফসল ফলত না বলে কেউ কিনতেও চাইতো না। এখনও একটা বড় জমি রয়েছে। সেটিতে সময়ের ব্যবধানে এখন ফসল জন্মালেও জমিটির মাঝখান বরাবর ফসল ফলে না।

রাজা কানাই লাল পালের ছিলো অপরূপ সুন্দর দুটি কন্যাসন্তান। মেঘনা আর যমুনা। রাজা তার ২ কন্যাকে বড্ড বেশি ভালবাসতেন, প্রশ্রয়ও। জীবদ্দশায় তিনি ২ কন্যাকে পৃথক দুটি প্রাসাদ নির্মাণ করে দেন। এমনকি পৃথক অট্টালিকার সামনে দুটি বিরাট আয়তনের দিঘী কেঁটে দেন। সেখানে শানবাঁধানো ঘাট নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। পুকুরের পাড়েই ফুলের নন্দন কানন, তারপাশে ফলের বাগান। বর্তমানে আলমডাঙ্গা-জামজামি সড়কের দু পাশে দু রাজকন্যার রাজত্ব ছিলো।

একদিকে, যে পাশের মাঠকে ছোট যমুনা বলা হয়, সম্ভবত এখানে বসতি ছিলো রাজকুমারী মেঘনা রাণী পালের । আর অপর পাশের মাঠ যেটা বর্তমানে বড় যমুনার মাঠ হিসেবে পরিচিত, এটি ছিলো রাজকুমারী যমুনা রাণী পালের বসতিস্থল। বেশ কিছু বছর পূর্বেও এ মাঠে ছোট রাজকন্যা যমুনার বিশাল দিঘীর অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিলো বলে বিনোদপুরের বয়স্ক অনেকেই দাবি করেছেন।

বিনোদপুর গ্রামের আজিম উদ্দীনের বয়স এখন ৯০ বছর। তিনি জানান, ছোট বেলায় অনেকের মতো তিনিও এ বিশালায়তন দিঘী দেখেছেন। সেখানে ভাঙা শান বাঁধানো ঘাট ছিলো বলে তার দাবি। তিনি সেই দিঘীতে মোষ নামিয়ে গোসল করাতেন বলে জানান। এখন ওই পুকুরের জমি ভোদুয়া গ্রামের মসলেম হাজির দখলে। আজিম উদ্দীনের সাথে যখন কথা হয়, সে সময় একই গ্রামের আরেক বয়স্ক ব্যক্তি মহি উদ্দীনসহ উপস্থিত বয়স্করা সকলেই দাবি করেন বিরাট দিঘী ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে গেলেও সব সময়ই ওই মাঠ নিচু ছিলো। ওই মাঠকে অভিশপ্ত ভাবা হতো। কারণ কেউ সেখানে আবাদ করতেন না। যারা আবাদ করতে গেছেন তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন তারা। এই মাঠে কিছু জমি চাষ করতে গেলে ঘোষবিলার এক ব্যক্তির বাড়ি দিনের বেলা আগুন লেগে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায় বলে জানা যায়। এক সময় আলমডাঙ্গার ইব্রাহিম খান (কসাই) আবাদ করতে গিয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফিরে যান। অনেক পরে ভোদুয়ার মসলেম হাজি আবাদ শুরু করেন। এখনও তার ছেলেদের অধিকারে থাকা এক দাগে ৩৭ বিঘা জমির মধ্যে প্রায় ১০ কাঠা জমিতে ফসল ফলে না বলে দাবি করা হয়।

তারা জানান, ছোটবেলায় দেখেছেন, বিস্তৃর্ণ এ মাঠজুড়ে জঙ্গল। কেউ আবাদ করতে সাহস পেতেন না। সকলের বদ্ধমূল ধারণা ছিলো এখানে জিনদের বসবাস। বছরের একটা নির্দিষ্ট মাসের আমাবস্যার রাতে জিনদের এই মাঠে সম্মেলন হত। সে সময় আলোয় আলোয় মাঠ ভরে যেত। জিনেরা খানাপিনা করতেন। এমনকি তাদের সম্প্রদায়ের বিয়ের অনুষ্ঠানও এই মাঠে হতো বলে বেশ দৃঢ়তার সাথে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জানান কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি। এমনকি এই দৃশ্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ উপযোগ করতেন বলে তাদের দাবি।

এলাকাবাসীর ধারণা অভিশাপগ্রস্ততার কারণে জিন সম্প্রদায় রাজকন্যা মেঘনা ও যমুনার রাজত্ব সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছে। তবে শিক্ষিতদের ধারণা, পূর্বে কিছু কিছু ছোঁয়াচে রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তো। সে রকম কোনো রোগের মহামারি প্রকোপে ধ্বংস হতে পারে দু রাজকন্যার সাধের বসতি। আবার প্রচন্ড ভূমিকম্পে মুহূর্তেই হয়তো এই দু রাজকন্যার বসতি ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনকি ভূমিরূপও পরিবর্তন হয়ে গেছে। কুমার নদের গতিপথ চেঞ্জ হয়েছে। কুমার কিছুটা দূরে সরে গেছে। তার সাবেক বুকজুড়ে বালিয়াড়ি জন্মেছে। হয়েছে আসমতল মাঠ। সেকারণে নিচু অংশগুলো কালক্রমে বদনা দোয়া, বিলের দাড়ি, কালিপুকুর, পুকুরদোব, রামাদোহা নামে পরিচিতি পেয়েছে।

কিংবদন্তীর রাজকন্য যমুনা মাঠের একটি অপরিচিত গাছকে নিয়েও আছে জননন্দিত আরেক কিংবদন্তী। (বর্তমানে গাছটির অস্তিত্ব নেই। কয়েক বছর আগে কেঁটে ফেলা হয়েছে)।

জানা যায়, এই বৃহত্তর এলাকার কোনো প্রজাতির গাছের সাথে তার মিল পাওয়া যেত না। এ গাছকে এলাকাবাসী তাই ‘অচিন গাছ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এলাকাবাসীর দাবি পার্শ্ববর্তী ভোদুয়া গ্রামের জনৈক কবিরাজ ভারতের কামরূপ-কামাক্ষায় যাদুবিদ্যা ও কবিরাজি শিখতে যান। দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থানের পর এক রাতে ওস্তাদের অনুমতি নিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। তিনি কামরূপ-কামাক্ষা থেকে একটি বৃক্ষে সওয়ার হয়ে এত দীর্ঘ পথ পাড়ি জমান। যমুনা মাঠে পৌঁছে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে, ভোর হয়ে যায়। মানুষ যাতে বৃক্ষে চড়ে কবিরাজের বাড়ি ফেরার কেরামতি দেখতে না পায়, সে জন্য তিনি ওস্তাদের নির্দেশ মোতাবেক যমুনা মাঠে ‘অচিন গাছ’ ফেলে রেখে বাকি পথটুকু পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন। আর ‘অচিন গাছটি’ সেখানেই মাটির বুকে তার শেকড় প্রোথিত করে কিংবদন্তীর জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে টিকেছিলো!

কৃতজ্ঞতা স্বীকার–শ্রদ্ধেয় আব্দুল জব্বার–সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, অগ্রজ আজিম উদ্দীন মণ্ডল, মহি উদ্দীন মণ্ডল ও সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক কর্মী আতিক বিশ্বাস।