যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট আজ নির্বাচন

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: দীর্ঘ ক্লান্তিকর প্রচারণা শেষে আজ আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ভোটগ্রহণের সময়ে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও বেশিরভাগ রাজ্যেই সকাল ৬টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হবে। আর তা চলে স্থানীয় সময় রাত ৮টা পর্যন্ত (বাংলাদেশের সময় বুধবার সকাল পর্যন্ত)। এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন এবং বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে। এবারের নির্বাচনে প্রাপ্তবয়স্ক বৈধ ভোটারের সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি। তবে ২০১২ সালে মাত্র ৫৪ শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন। তাই আজকের ঠাণ্ডা আবহাওয়া উপেক্ষা করে কত শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হন তার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। আজকের নির্বাচনে লড়াইটা হচ্ছে মূলত হিলারি ও ট্রাম্পের মধ্যেই। তবে তারা ছাড়াও আরও উল্লেখযোগ্য দুই প্রার্থী হলেন লিবার্টারিয়ান পার্টির গ্যারি জনসন এবং গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন। এছাড়াও আছেন কনস্টিটিউশন পার্টির ড্যারেল কাসল এবং নির্দলীয় প্রার্থী ইভান ম্যাকমালিন।

উল্লেখ্য, ইভান দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একজন সাবেক কর্মকর্তা। এদিকে আজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পাশাপাশি প্রতিনিধি পরিষদের (কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হিসেবে পরিচিত হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস) ৪৩৫ জন সদস্য এবং সিনেটের (কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ হিসেবে পরিচিত) ৩৪ জন সদস্য নির্বাচনেও ভোট দেবেন আমেরিকানরা। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসে যাওয়ার মতো কংগ্রেসে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাও আমেরিকায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসব ছাড়াও দেশটির ১২টি অঙ্গরাজ্যের গভর্নর, বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচন এবং বিভিন্ন ইস্যুতে গণভোটও একযোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজকের ভোটগ্রহণ থেকেই নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফল জানা যাবে না। কারণ আমেরিকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নয়; বরং পরোক্ষভাবে ইলেক্টোরাল ভোটেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ইলেক্টোরাল কলেজের প্রতিনিধিরা প্রেসিডেন্ট পদে সরকারিভাবে ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে ফল ঘোষণা করবেন। তবে বেসরকারি গণনায় বাংলাদেশ সময় বুধবার সকালেই জানা যাবে ফল।

এর আগে সোমবার প্রকাশিত সর্বশেষ জরিপেও ট্রাম্পের চেয়ে সামান্য এগিয়ে থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন হিলারি। পলিটিকো ও মর্নিং কনসাল্টের জরিপ অনুযায়ী, শেষ মুহূর্তে তিন শতাংশে এগিয়ে আছেন তিনি। রিয়ালক্লিয়ারপলিটিক্স ট্রাম্পকে ১.৮ শতাংশে পিছিয়ে রেখেছে। তাছাড়া ওয়াল স্ট্রিট এবং এনবিসির জরিপ থেকে জানা গেছে, হিলারির পক্ষে আছেন ৪৪ শতাংশ ভোটার। আর ট্রাম্পের পক্ষে ৪০ শতাংশ। আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৩৩টি গত পাঁচটি নির্বাচনে একই দলকে ভোট দিয়েছে। তাই সুইং স্টেটের (দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য) দিকেই তাকিয়ে আছে সচেতন মহল। ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া, ওহাইও ইত্যাদি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। আর তাই নির্বাচনী প্রচারণার একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত এই রাজ্যগুলোতে বিশেষভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রার্থীরা। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলও অনেকটা এগুলোর ওপরই নির্ভর করে।

এদিকে জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদা ও আইএস ছাড়াও নির্বাচনের দিন আমেরিকার ভোটকেন্দ্রে হামলার হুমকি দিয়েছে কট্টরপন্থী সংগঠন কেকেকে এবং জর্জিয়া সিকিউরিটি ফোর্স থ্রি পার্সেন্ট। তাই ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি সতর্ক অবস্থায় রয়েছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। দেশটির পুলিশ, সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনী ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদান অব্যাহত আছে। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছে বিশেষ বাহিনী। পুলিশের পক্ষ থেকে সাধারণ নাগরিকদের নিশ্চিন্তে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে। প্রায় ২৫০ বছরের ইতিহাস পাল্টে এবার প্রথম কোনো নারী প্রেসিডেন্টকে কী বরণ করতে যাচ্ছে আমেরিকা, নাকি নারী, মুসলিম, অভিবাসী-বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ট্রাম্পই হবেন নতুন দিনের আমেরিকার কাণ্ডারি তা দেখার অপেক্ষায় শুধু আমেরিকানরাই নয়, অপেক্ষা করছে গোটা বিশ্বই।

ওহাইওতে জিতলেই প্রেসিডেন্ট: আমেরিকাতে ক্রিকেট জনপ্রিয় না হলেও এ দেশে নির্বাচনের খেলায় সুইং করার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। মোটামুটিভাবে ১১টি সুইং স্টেট রয়েছে যেখানে ভোটের হিসেব ঝুলে আছে সূক্ষ্ম সুতায়। অর্থাৎ এসব রাজ্যে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতি সমর্থন প্রায় সমান সমান। তাই ভোটের ফলাফল যে কোনো সময় যে কোনো দিকে যেতে পারে।
একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদক বলেন, এবার নির্বাচনের খবর জোগাড় করতে গিয়ে যেখানেই গিয়েছেন, মানুষজনের সঙ্গে কথা বলা পর মোটামুটিভাবে আন্দাজ করতে পেরেছেন ভোটের হাওয়া কোন দিকে বইছে। কিন্তু ক্লিভল্যান্ডে এসে সব গুলিয়ে গেছে।
এখানে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হয়েছে এরা হয় হিলারি ক্লিনটন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প দুজনকেই ভালবাসেন, নয়তো দুজনকেই অপছন্দ করেন। ওহাইও এমন প্রার্থীকে বেছে নেয় যে নির্বাচনে বিজয়ী হয়। এর পেছনে কারণ হলো তারা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেন যে ভোটটি কাকে দেবেন- ব্যাখ্যা করছিলেন ক্লিভল্যান্ডের প্রতিবেশী শহর অরোরার বাসিন্দা জ্যানেট।
তিনি জানান, বেশিরভাগ ওহাইওয়ান বাস্তববাদী। প্রার্থীদের মিষ্টি মিষ্টি কথায় তারা ভোলেন না। নির্বাচনের আগে ঝলমলে প্রতিশ্রুতিকে তারা পাত্তা দেন না। জনপ্রিয় টিভি টকশো হোস্ট জেরি স্প্রিঙ্গার একবার এখান থেকে সিনেট নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন এবং তুমুল জনপ্রিয় হলেও ওহাইওয়ানরা তাকে ভোট দেননি। সুইং স্টেটগুলোর মধ্যে ওহাইওর রয়েছে চমকপ্রদ ইতিহাস।

গত ৩০ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ২৮ জনই ওহাইও অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। ১৯৬০ সাল থেকে ওহাইও এমন সব প্রার্থীকে বেছে নিয়েছে যারা শেষপর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সে কারণেই রাজনৈতিক পণ্ডিতরা ওহাইওকে রাষ্ট্রপতিদের সূতিকাগার বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু প্রার্থী বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে ওহাইওয়ানরা প্রার্থীর কোন কোন গুণাবলীর দিকে নজর রাখেন? ছোট্ট এক শহর পেরিসবার্গের বাসিন্দা লোরি বললেন, এমন একজনকে তিনি বেছে নিতে চান যিনি সৎ ও গণতান্ত্রিক। ওহাইওতে বহু খেটে খাওয়া মানুষ রয়েছেন। বহু মানুষ আছেন যারা সামরিক বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা চান তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হোক। সেটা বিবেচনা করেই তারা ভোট দেবেন। নির্বাচনের প্রচারকার্য চালানো যাদের দায়িত্ব তারা সুইং স্টেট হিসেবে ওহাইওকে বেশি পছন্দ করেন। তার পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ। এই অঙ্গরাজ্যকে বলা যায় সারাদেশের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। এই স্টেটে শহর-গ্রাম, ধনী-গরিবের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ভারসাম্য রয়েছে। এখানে শ্বেতাঙ্গ ভোটার বেশি। হিসপ্যানিক ভোটার অন্যান্য স্টেটের তুলনায় কম।
এছাড়া ন্যাশনাল পালস বা জাতীর হৃদস্পন্দনকে ওহাইওয়ানরা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন। অ্যানা নরডিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্লিভল্যান্ডে আছেন। এই শহরের পরিবর্তনগুলো তার চোখের সামনেই ঘটেছে। তিনি বলছিলেন, আগে নিরাপত্তার ইস্যুটা খুব বড় প্রশ্ন ছিল কিন্তু এখন মানুষের প্রধান চিন্তা তার চাকরি-বাকরি। তারা ভাবেন তাদের চাকরি থাকবে কিনা, বাড়ির মর্টগেজ তারা ধরে রাখতে পারবেন কিনা কিংবা পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব তারা ঠিকমতো পালন করতে পারবেন কিনা ইত্যাদি।’ এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ওহাইওর ওপর। প্রতিদিনই কোনো না কোনো প্রার্থী কিংবা তার পক্ষে কেউ না কেউ আসছেন ভোট চাইতে। প্রচারের কাজে ব্যয় করছেন লক্ষ লক্ষ ডলার। গত শুক্রবারেই ক্লিভল্যান্ডে হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন করে এক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন পপতারকা জে-যি এবং তার স্ত্রী বিয়ন্সে। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। ওহাইওর ভোটাররা কাকে বাতিল করবেন? হিলারি না ট্রাম্পকে?
ট্রাম্প এখানে জিতলে সারাদেশেও তিনি জিততে পারবেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। অন্যদিকে অতীতে ওহাইওতে না জিতেও ডেমোক্রেটিক প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ১৯৬০ সালের সেই নির্বাচনের নায়ক ছিলেন জন এফ কেনেডি। ওহাইওর মন জয় করতে হলে হিলারি ক্লিনটনকে হয়তো কেনেডি হতে হবে।

     হিস্পানিক ভোটে বিপদ সামলাবেন হিলারি: এদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিততে হলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নেভাদা ও ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্য নিজ দখলে আনতে হবে- এ কথা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। সে জন্য নির্বাচনী প্রচারণার শেষ সপ্তাহে তিনি বারবার এই দুই রাজ্যে ফিরে গেছেন। কিন্তু আগাম ভোটের হিসাব যদি সঠিক হয়, ট্রাম্প সম্ভবত এই দুই রাজ্যই হারাচ্ছেন, এর সঙ্গে সঙ্গে তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন। আর এই হার হয়তো তাকে মানতে হবে হিস্পানিক ভোটারদের কারণে, যাদের তিনি ধর্ষক ও মাদক ব্যবসায়ী বলে নিন্দা করেছিলেন। একাধিক সংবাদমাধ্যম নিশ্চিত করেছে, নেভাদায় হিস্পানিকদের আগাম ভোটের পরিমাণ আগের যে কোনো সময়ের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পলিটিকো জানিয়েছে, এই রাজ্যের সবচেয়ে জনবহুল ক্লার্ক কাউন্টিতে হিস্পানিকদের কারণে হিলারি কমপক্ষে ৭২ হাজার ভোটে এগিয়ে আছেন। এই রাজ্যের একজন নির্বাচনী বিশ্লেষক জানিয়েছেন, নেভাদাকে হিলারির খাতায় তুলে দিতে এই সংখ্যা পর্যাপ্ত। ২০১২ সালে ওবামা নেভাদা জিতেছিলেন ৭ পয়েন্টে। সেবার এই কাউন্টিতে ডেমোক্রেটদের পক্ষে আগাম ভোট পড়েছিলো ৭১ হাজার। একজন ডেমোক্রেটিক কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্প চেয়েছিলেন মেক্সিকোর সাথে দেয়াল তুলতে। নেভাদায় সেই দেয়াল তিনি পেয়ে গেলেন, তবে এই দেয়াল হিস্পানিক ভোটারদের তোলা দেয়াল।

ফ্লোরিডা থেকেও খবর এসেছে, রোববারে সমাপ্ত আগাম ভোটে সেখানে প্রায় ৬২ লাখ মানুষ ভোট দিয়েছেন, যার ১০ লাখ ভোটার হলেন হিস্পানিক। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নির্বাচনী পরিসংখ্যান বিশারদ জানিয়েছেন, তার হিসাব অনুযায়ী এই হিস্পানিক ভোটারদের এক-তৃতীয়াংশই এ বছর প্রথমবারের মতো ভোটে অংশ নিচ্ছেন।