মোদির ঢাকা সফরে প্রাধান্য রাজনীতি ও অর্থনীতি

 

স্টাফ রিপোর্টার: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরে রাজনীতি ও অর্থনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। ঢাকা ও দিল্লির রাজনৈতিক মহলে এ সফর বেশ আলোচিত। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদি ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিলেও রাজনীতি ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তিস্তার প্রভাব, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন, মমতা ব্যানার্জির সাথে মোদির রাজনৈতিক সম্পর্ক ঘুরেফিরেই আসছে এ সফরে। পাশাপাশি, সফরকালে কানেকটিভিটিসহ বাণিজ্য জোরদারে সুস্পষ্ট নানা পদক্ষেপ নেয়া হবে।

বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী রোববার সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন বাস্তবধর্মী ব্যক্তি। অন্তত একটা চুক্তি করে তিনি বাংলাদেশে যেতে চাইছেন। সে জন্য তিনি সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন করেছেন। এ চুক্তির অনুসমর্থন হবে ঢাকায়। তিস্তাটা হবে না। তবে মমতাকে এ ব্যাপারে কিছুটা পটিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এর মধ্যে একবার কলকাতা গিয়েছিলেন। সেখানে একটা সংলাপ হয়েছে। সেখানে মোদি কিছুটা রাজি করাতে পেরেছেন। বলা যায়, মমতা ৫০ শতাংশ রাজি। তিনি আরও বলেন, মোদির সরকার পশ্চিমবঙ্গকে কিছুটা আর্থিক সহায়তা দেবে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের একটা বিষয় আছে। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী আরও বলেন, মোদির সফরে অর্থনীতিই অগ্রাধিকার। তবে কোনো অর্থনীতিই রাজনীতি থেকে আলাদা নয়। রাজনৈতিক দিক থেকে এ সফর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণ সমর্থন দেয়া হবে। নতুন ঋণ ঘোষণা করা হবে। কানেকটিভিটি রেলওয়ে, রাস্তাঘাট এসব কাজে ঋণ দেয়া হবে। বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলায় আইটি সেন্টার করার স্থাপনা নির্মাণে সহায়তা দেয়া হবে। অশুল্ক বাণিজ্য বাধা অপসারণে কিছু হবে যাতে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। নিরাপত্তা তথা সন্ত্রাস দমনে কিছু হতে পারে।

মোদির সফরে বাংলাদেশের রাজনীতি যে একটা প্রধান বিষয় তা স্পষ্ট ভারতের প্রভাবশালী টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, মোদি সফরকালে এমন একটি শক্তিশালী বার্তা দেবেন যা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করবে। এটাই হবে তার সফরের সর্বোচ্চ থিম। হাসিনাকে ভালো প্রতিবেশী মনে করা হয় একটি কারণেই আর সেটি হলো নিরাপত্তা। তার বদলে ভারতের প্রতিদান দেয়ার সময় এখন। মোদি ঠিক কীভাবে শেখ হাসিনাকে এ প্রতিদান দেবেন সে সম্পর্কে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। বিশেষ করে তিস্তার পানিবণ্টনের ইস্যুকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কারণে গুরুত্বের দিক থেকে অনেক নিচে রাখা হয়েছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মোদির সরকার শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক সুবিধা দিতে চাইলে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করা জরুরি। কেনোনা তিস্তার চুক্তি না হলে শেখ হাসিনা সরকারের বিরোধীরা সুবিধা পাবে। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনের পূর্বে কিছুতেই তিস্তা চুক্তি করতে দিতে চান না মমতা। ফলে বাংলাদেশ গুরুত্ব দিলেও তিস্তার ইস্যুকে সে পরিমাণে অগ্রাধিকারে রাখতে চাইছে না ভারত। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি তিস্তাকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ার আশঙ্কা মমতা ব্যানার্জির।

মোদির সফরে অর্থনৈতিক ইস্যু যে গুরুত্ব পাচ্ছে সেটা বিভিন্ন চুক্তির দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়। ভারত বন্দর ও কানেকটিভিটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমন্বয় চাইছে। স্পর্শকাতরতার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আলোচনা থেকে ‘ট্রানজিট’ শব্দটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কানেকটিভিটিকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার মানে হল বাণিজ্য বৃদ্ধি করা। ঢাকা সফরকে সামনে রেখে ভারতের মন্ত্রিসভায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে জাহাজ পরিবহনবিষয়ক একটি চুক্তির খসড়ায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সে চুক্তি অনুসারে দু দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহনের পথ আরও সুগম হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় যেখানে যেখানে চেকপোস্ট আছে, ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন আছে, সেখানে দ্রুত সড়ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে শনিবারের সে বৈঠকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রের বরাতে আনন্দবাজার জানায়, দক্ষিণ এশিয়ায় এ মুহূর্তে বাংলাদেশই ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী। ফলে এ চুক্তি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে আশা করছেন তারা। আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হলেও দিল্লির কাছে এদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি বলে মনে করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আসন্ন ঢাকা সফরকে এতো গুরুত্ব দেয়ার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে শনিবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের কাছে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন তিনি।

শেখ হাসিনার সরকার বেশ কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাস দমনে অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে উল্লেখ করে মন্ত্রিসভার সদস্যদের মোদি বলেন, এ পরিস্থিতিতে তিনি মনে করেন, উন্নয়নই দু দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে মজবুত করার কাজে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে পারে। তার মতে, দু দেশের যোগাযোগ যতো বাড়বে, পারস্পরিক আস্থাও ততো বাড়বে। সে উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতেই একগুচ্ছ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে দিল্লি। পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক সংবাদপত্র আনন্দবাজারকে দেয়া সাক্ষাৎকারেও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কে তার ঢাকা সফর এক নতুন অধ্যায় সূচিত করতে চলেছে বলেও আশা প্রকাশ করেন মোদি। শনিবার আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাথে মধুর সম্পর্ক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে। সীমান্ত নিয়ে মনোমালিন্য মিটে গেলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্ব আরও মজবুত হবে বলে মনে করেন নরেন্দ্র মোদি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমস্ত রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলে পার্লামেন্টের অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশের সাথে স্থলসীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে চলেছে ভারত। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে এ সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিলো। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পরও সে বিতর্ক বহাল রয়ে গেছে। আমরা এ বিতর্কের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করছি এবং সেটা সর্বসম্মতির ভিত্তিতে। এটা আদৌ সামান্য ঘটনা নয়।

মানব পাচারবিরোধী এক বিশেষ সমঝোতা স্মারকের খসড়াতেও অনুমোদন দিয়েছে দেশটির মন্ত্রিসভা। অপরাধ দমনের পাশাপাশি এ বিষয়টি নিয়ে দু দেশের সীমান্ত এলাকায় প্রায়ই গোলযোগ লেগে থাকে তাও কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। সফরকালে ঢাকা-শিলং-গৌহাটির মধ্যে বাস সার্ভিসের উদ্বোধন হবে।

চালকের আসনে মমতা: বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে অর্জন চাইছে তার চালকের আসনে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই মমতাকে এ আসনে বসিয়েছেন। মমতা ২০১১ সালে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরকে রীতিমতো ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে ওই সফরে আসেননি তিনি। দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে, শেখ হাসিনার সাথে মোদির প্রায় সব আলোচনায় উপস্থিত থাকবেন মমতা। এ শর্তে মমতা তিস্তা চুক্তি করার পক্ষে অনুমোদন দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেটা হতে হবে ২০১৬ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনের পর। মোদির সফরসঙ্গী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি আসছেন ঠিকই তবে তারা এক সাথে আসছেন না। মমতা ঢাকায় আসবেন একদিন আগে ৫ জুন। মোদির ফেরার একদিন আগে অর্থাৎ ৬ জুন ভারত ফিরে যাবেন। মোদি ফিরবেন ৭ জুন। মমতাকে সাথে নিয়ে মোদি বাংলাদেশকে এ বার্তা দিতে চাইছেন যে, মনমোহন সিং যেটা পারেননি, সে তিস্তা চুক্তি করতে মমতাকে সাথে রাখছেন তিনি। তিস্তা নিয়ে মোদি কোনো কথা বলবেন না বলে মমতাকে আশ্বস্ত করেছেন। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা ইস্যু উত্থাপন করা হবে। সে ক্ষেত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের প্রশ্নে দিল্লির অবস্থানের কথা বলতে পারেন। কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে আগরতলা সরাসরি বাস চলাচলের সূচনা করবেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এ প্রথম ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বাস যাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে। আগামী ৪ জুন বিকেলে কলকাতায় রাজ্য সচিবালয় নবান্নের সামনে থেকে এ বাসযাত্রার সূচনায় পতাকা নাড়বেন তিনি। রাজ্যের আবাসন ও যুবমন্ত্রী অরুপ বিশ্বাস ও পরিবহন দফতরের প্রধান সচিব আলাপন ব্যানার্জিসহ ৪০ জনের প্রতিনিধি দল নিয়ে বাসটি পেট্রাপোল ও বেনাপোল হয়ে ঢাকায় পৌঁছবে। প্রতিনিধিদের মধ্যে সাংবাদিকরা ছাড়াও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিও থাকতে পারেন। ঢাকায় যাত্রাবিরতির পর ৬ বা ৭ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাসটিকে আগরতলার অভিমুখে যাত্রার সূচনা করবেন।