মেহেরপুর অঞ্চলে সজারু এখন আর চোখে পড়ে না

 

মহাসিন আলী: বিলুপ্ত প্রায় প্রাণিগুলোর মধ্যে সজারু একটি। মেহেরপুরে আগের মতো এখন আর এ প্রাণিটি চোখে পড়ে না। রাতের আঁধারে ঝুমঝুম শব্দ আর মান কচু খেয়ে যাওয়া এক সময় সজারুর উপস্থিতি স্মরণ করে দিতো। সবজি ও ছোট ছোট গাছ খেয়ে এরা জীবনধারণ করে। বড় ধরনের উপকারে না এলেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এদের ভূমিকা কম নয়। প্রায় দু যুগ আগেও সজারুর কথা মেহেরপুরের মানুষের মুখে ছিলো। সজারু নামের প্রাণিটি এখন এ অঞ্চলের মানুষের গল্পে পরিণত হয়েছে। এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন চিড়িয়াখানা থেকে বিপন্ন প্রায় এ প্রাণিটির অস্তিত্ব উপলব্ধি করে।

মেহেরপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ও বিএম কলেজের প্রভাষক আসকার আলী বলেন, আশির দশকের শেষের দিকে তার এলাকা মেহেরপুর সদর উপজেলার নূরপূর গ্রামে সজারুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেতো। মান কচু ও মাটির তলার আলু খেয়ে এরা ক্ষেত নষ্ট করতো। গ্রামের বাঁশঝাড়ের মুড়োর মধ্যে গর্ত করে বাস করতো এরা। তিনি আরো বলেন, মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান গ্রামের অনেকে নূরপুর গ্রামের বাঁশঝাড়ের নিচের মাটি খুঁড়ে সজারু ধরে নিয়ে যেতো। তারা সজারুর মাংস খেতো। এখন সজারু চোখে পড়ে না আর কেউ সজারু ধরতে আসে না।

মেহেরপুর কবি নজরুল ইসলাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ইসলাম আলী জানান, এখন আর সজারু দেখা যায় না। এখন থেকে ২০/৩০ বছর আগেও মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় সজারু দেখা যেতো। রাতের বেলা সজারু বের হলে ঝুম ঝুম শব্দ শোনা যেতো। সকালে ছেলে-মেয়েরা সজারুর কাটা কুড়াতো। অনেক মেয়েদের সজারুর কাটা খোঁপায় গুজতে দেখা যেতো। বাগদিরা এলাকা থেকে মাটি খুঁড়ে সাজারু ধরে নিয়ে যেতো। তারা সাজারুর মাংস খেতো। এখন শুধু মেহেরপুরেই নয়; জেলার আশপাশের জেলাগুলোতেও সজারু আছে বলে শোনা যায় না। এরা দেশি সজারু বা ভারতীয় সজারু নামে পরিচিত। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান, নেপান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, তুর্কিমেনিস্তান, চীন ও মধ্য এশিয়ার দেশে সজারু দেখা যায়। পাহাড়-পর্বত, উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলী অঞ্চলের সমতল ভূমি ও সংশ্লিষ্ট বনাঞ্চলে সজারু দেখা যায়।

তিনি আরো বলেন, দেশী সজারু ৩ ফুট বা তার বেশি লম্বা হয়ে থাকে। পূর্ণ বয়স্ক সজারুর ওজন সাড়ে ১৪ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের দেহের বহিরাবরণের পশমগুলো মোটা। এদের দেহে কয়েকস্তর বিশিষ্ট শক্তিশালী, ধারালো ও তীক্ষ্ম ধারালো কাঁটা রয়েছে। দীর্ঘতম কাঁটাটি কাঁধের দিকে জন্মায় এবং এর দৈর্ঘ দেহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হয়ে থাকে। এর লেজও ছোট কাঁটার আবরণে পূর্ণ যা এরা আত্মরক্ষার্থে ব্যবহার করে থাকে ও বিচ্ছুরণ ঘটনায়। এর বিস্তৃত পা ও লম্বা থাবা রয়েছে। সজারু যখন আক্রমণের শিকার হয় তখন তার দেহস্থ কাঁটাগুলো সক্রিয় হয় ও লেজ থেকে খসে গিয়ে শিকারীকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করে। যদি কোনো কারণে এদের বিষাক্ত কাঁটা শিকারীর গায়ে বিদ্ধ করে তবে মৃত্যু কিংবা গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।

স্ত্রী জাতীয় সজারু ২৫ মাস ও পুরুষ জাতীয় সজারু ২৯ মাস বয়সে যৌবন প্রাপ্ত হয়ে থাকে। স্ত্রী সজারুর গর্ভধারণকাল ২১০ দিন। এরা বছরে এক থেকে ৪টি পর্যন্ত শাবক প্রসব করে। নিশাচর প্রাণী হিসেবে দেশী সজারু দিনের বেলা মাটির নিচে আশ্রয় নেয়। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে এরা বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলে। সজারু ঘাস, লতা-পাতা ও ছোট ছোট গাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে। ক্ষুধা মিটাতে এরা বিভিন্ন ধরনের গাছপালার পাশাপাশি ফলমুল, শষ্য, গাছের শিকড় পর্যন্ত খেয়ে ফেলে।

মেহেরপুর জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা ডা. শশাংক কুমার মণ্ডল বলেন, প্রাণী মাত্রই ভীতু। প্রাণি আত্মরক্ষার্থে শিকারীকে আক্রমণ করে থাকে। সজারুর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম নয়। আক্রমণের শিকার হলে সজারুর দেহস্থ কাঁটাগুলো সক্রিয় হয় ও লেজ থেকে খসে গিয়ে শিকারীকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করে। এরা কোনো না কোনোভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই বিপন্ন প্রায় প্রাণিটি রক্ষার্থে আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত।