মেহেরপুরের মুক্তিযোদ্ধা ছাদেক হোসেনের একাল-সেকাল

মেহেরপুর অফিস: মেহেরপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাদেক হোসেন। ৭১’র রণাঙ্গণের লড়াকু সৈনিক। তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে আনসার কমান্ডার ছিলেন। তার ওস্তাদ ছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেনা বাহিনীর হাবিলদার মোস্তাক খান। তিনি মেহেরপুর মহকুমা স্বাস্থ্য বিভাগের ডা. সামসুজ্জোহা কোরাইশীর অধীনে ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার সাথে ছিলো বসন্ত নির্মূল অভিযানের ল্যান্ড রোভার জিপগাড়ি (ঢাকা-ব-৯৬)।

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। তাদের প্রতিহত করতে ১৯৭১ সালে সপরিবারে তিনি ভারতের নদীয়া জেলার তেহট্টো থানার লালবাজারে চলে যান। সেখানে ইয়্যুথ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার কাজের পারদর্র্শিতায় সেখান থেকে তাকে ১৪দিন পর লালবাজারের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন ইয়ার আযম চৌধুরীর কার্যালয়ে মেডিক্যাল টিমে কাজ করার জন্য নিয়ে আসা হয়। এ মেডিক্যাল টিমের প্রধান ছিলেন ডা. আব্দুল মান্নান। রণাঙ্গণে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার কাজে তিনি নিয়োজিত হন। বাংলাদেশের সীমান্তে পাক সেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চলাকালীন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, গুলি, ওষুধ ও খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করতেন। প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তিনিও অস্ত্রহাতে মুখোমুখি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। গুলিবিদ্ধ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের গাড়ি করে ভারতের শক্তিনগর হাসপাতালে ভর্তি করাতেন। এছাড়া তিনি ক্যাপ্টেন ইয়ার আযম চৌধুরীকে কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন মিশনে নিয়ে যেতেন। তিনি একদিন ভারতের চাপড়া মুক্তিযোদ্ধা মেডিক্যাল টিমে গিয়ে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের মেডিক্যাল টিমের জেনারেল সেক্রেটারি ডা. সামসুজ্জোহা কোরাইশের সন্ধান পান।  তারপর থেকে তিনি সেখানে কাজ করতে থাকেন।

এর আগের ঘটনা তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ মেহেরপুর মহাকুমা প্রশাসক তৌফিক-ইলাহী ও স্থানীয় এমপি ছহিউদ্দিনের নির্দেশে ঢাকা থেকে আসা এমপি আশরাফুল ইসলাম নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে তিনি জিপগাড়িতে করে মেহেরপুরের ইছাখালি সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের বেতায় ওঠেন। সেখানে একটু বিশ্রাম নিয়ে কৃষ্ণনগর হয়ে কলকাতার মগবাজারের এক বাসায় তাকে পৌঁছে দেন। এ সময় সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরেন এবং বিভিন্ন প্রশ্ন রাখেন। ভারতে যাওয়ার সময় এ গাড়িতে আরো ২ আওয়ামী লীগের নেতা  ছিলেন। এরা হলেন মেহেরপুর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম খাদেম আলী ও আশরাফুল হক পোটল। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি নিজ গ্রাম বন্দর থেকে ৬৪ জন আনসার সদস্য সাথে নিয়ে ৭১’র ৩১ মার্চ কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন ও জিলা স্কুলে পাক সেনাদের সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন গাংনীর মহাম্মদপুর গ্রামের সাবেক ক্যাপ্টেন এমপি নূরুল হক ও ক্যাপ্টেন ইয়ার আযম চৌধুরী। এ ভয়াবহ যুদ্ধে অনেক আনসার, ইপিআর, মুজাহিদ ও পুলিশের প্রাণ ঝরে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তার আপন ভাগনে আনসার মুনসুর পাক সেনাদের গুলিতে মারাত্মক আহত হয়। বাড়িতে নিয়ে আসার ৬ দিন পর চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।  রাষ্ট্রীয়ভাবে কেউ তার খোঁজ রাখেনি। তার কবরও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভাগনে মারা যাওয়ার পর এবং পাক সেনাদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে মনের দুঃখে তিনি ভারতে গিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ভাগনের ছবিকে বুকে ধারণ করে প্রতিজ্ঞা করেন, আর কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসার অভাবে মরতে দেবেন না। ডিসেম্বর মাস আসলে ভাগনের মারা যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়লেই রাতের আঁধারে সকলের অগোচরে গুমরে কাঁদেন। তিনি বলেন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পাইনি। এখন তিনি বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। তবুও তিনি কোনো জায়গায়  মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ হলেই সেখানে ছুটে যান। সহকর্মীদের কাছে পেয়ে একটু শান্তি পান।