মাথাভাঙ্গা পত্রিকা পেয়ে গ্রামের মানুষ আবেগ আপ্লুত

দামুড়হুদার ব-দ্বীপখ্যাত গ্রাম পাটাচোরা

 

তাছির আহমেদ: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ব-দ্বীপখ্যাত ছোট্ট একটি গ্রামের নাম পাটাচোরা। মাথাভাঙ্গা নদী ও ভৈরব নদের তীরবেষ্টিত গ্রামের ভূমিবিন্যাস মানসম্মত হওয়ায় এর উর্বরতা উল্লেখযোগ্য। ফলে নবাবী আমল থেকেই গ্রামে বসতি শুরু হয়। গ্রামের জনগণের বর্তমান অবস্থা সচ্ছল হওয়ায় শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক পরিবেশ ও পারস্পরিক সম্প্রীতি বেশ লক্ষণীয়। বিভিন্ন পরিবার বা গোষ্ঠীর বসবাস এ গ্রামে। এগুলোর মধ্যে মণ্ডল গোষ্ঠী অন্যতম। পাটাচোরা গ্রামের এ মণ্ডল গোষ্ঠীর আদি পুরুষগণ ছিলেন চুয়াডাঙ্গার সিন্দুরিয়া ও মহাম্মদজমা গ্রামের বাসিন্দা। নীল বিদ্রোহের সময় এ গোষ্ঠীর লোকজন মি. রিভস ও মি. শেরিফ সাহেবের সিন্দুরিয়া কুঠি এলাকা ত্যাগ করে মি. হিলস সাহেবের নিশ্চিন্তপুর কনসার্নের অধীন এ পাটাচোরা গ্রামে বসবাস শুরু করে। গ্রামটির পূর্ব নাম ছিলো জগন্নাথপুর। ইংরেজদের জোর করে বেধে দেয়া চুক্তির কবল থেকে মুক্ত হতে এ গ্রামের কিছু মানুষ স্থানীয় কুঠিবাড়ি থেকে নীলচাষ চুক্তির দলিলপত্র চুরি করে নেয়। ইংরেজদের ভাষায় এ দলিলের নাম ছিলো পাট্টা। পাট্টা চুরি করার অপরাধে ইংরেজরা এ গ্রামের নাম দেয় পাট্টাচোর। অবশেষে পাটাচোরা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ গ্রামের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আকুতি করে আসছিলো প্রাণের স্পন্দন দৈনিক মাথাভাঙ্গা গ্রামে পৌঁছে দেয়ার জন্য। কিন্তু সুষ্ঠু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এতোদিন তা হয়ে ওঠেনি। গত বুধবার সকালে গ্রামের মানুষ দৈনিক মাথাভাঙ্গা হাতে পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। এ সময় গ্রামের মানুষের সাথে আলোচনায় উঠে আসে গ্রামের নানা অজানা ইতিহাসসহ লোমহর্ষক কাহিনী।

মোটরযান নিয়ে গ্রামের মধ্যে সরাসরি প্রবেশের পথ একটি। তা হলো দেউলী-বদনপুর ভায়া নাপিতখালী তারপর পাটাচোরা অথবা চিৎলা-গোবিন্দহুদা ভায়া নাপিতখালী তারপর পাটাচোরা। এ পথ দিয়ে ভৈরব নদের তীর বেয়ে সকালে মাথাভাঙ্গা পত্রিকা গ্রামে পৌঁছে দিতে গেলে চোখে পড়ে ভৈরব নদের পাড়ে শুকোতে দেয়া অজস্র পাটকাঠি। পাটকাঠির মাথায় সকালের মিষ্টি রোদে ছোট ছোট দলে চুপটি করে বসে আছে অসংখ্য কালো ফিঙে-রাজ পাখি। গ্রামের অগ্রভাবে ঢুকতেই বিভিন্ন গাছগাছালি থেকে মুখরিত হচ্ছে নাম না জানা অসংখ্য পাখ-পাখালির কলতান। গ্রামের মানুষ দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার আগমনকে আন্তরিক সাধুবাদ জানায়। এখন থেকে প্রতিদিন মাথাভাঙ্গা গ্রামে আসবে শুনে গ্রামের মানুষ এ প্রতিবেদক ও এ রুটের দৈনিক মাথাভাঙ্গা বিক্রেতা দশমীর আক্তার হোসেনকে সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি অবসরপ্রাপ্ত স্কুলমাস্টার হাজি রেজাউল হক বলেন, আমি ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে দৈনিক মাথাভাঙ্গার লাইন বাই লাইন নিয়মিত পড়ি। কোনো কারণে একদিন মাথাভাঙ্গা না পড়লে আমার কোনো কিছু ভালো লাগে না। আমার এক ভাইপো ব্যবসার কাজ শেষে প্রতিদিন দামুড়হুদা থেকে ফেরার পথে ১টি মাথাভাঙ্গা আমার হাতে পৌঁছে দেয়। দিনের শেষে প্রতিদিন এ গ্রামে আমার জন্য একটি মাথাভাঙ্গা আসে। দৈনিক মাথাভাঙ্গা পড়ার এ অনুভূতি ব্যক্ত করার পর তিনি জানান, গ্রামের অনেক ইতিহাস। গ্রামের মানুষ ইংরেজদের পাট্টা চুরি করে কীভাবে রক্ষা পায় নীলচাষের কবল থেকে। পাকবাহিনীর নির্যাতনের সেই দূর্বিসহ স্মৃতি মনে হলে এখনও মন কিভাবে গুমরে ওঠে। লোমহর্ষক স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, আমরা ছিলাম চার ভাই। নিয়ামত আলী মন্ডল,উজল মন্ডল,ডা:ওয়াজেদ আলী এবং সর্বশেষ আমি। আমি ছাড়া বর্তমানে সবাই মৃত। আমাদের গোষ্ঠিসহ গ্রামের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। সে অপরাধে দেশ স্বাধীনের ঠিক দুদিন আগে পাশের গ্রামের এক রাজাকারের সহযোগিতায় পাক-সেনারা আমার সেজ ভাই উজল মন্ডলকে এ গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে ব্যানেট নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে মৃত শরীরকে সাতটি খন্ডে পরিনত করেছিল। মেজ ভাই ডা: ওয়াজেদ আলী ওই বেদনার বহুকষ্টে সাত টুকরার লাশটি নিজ হাতে টুকরোগুলিতে শেলাই দিয়ে জোড়া লাগিয়ে আমরা জানাযা দিয়ে দাফন করেছিলাম। চাচাতো ভাই মৃত গোলাম রহমান গ্রামটির উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। প্রতিষ্ঠিত করেছেন দু দুটি স্কুল। এছাড়া রাস্তা ঘাট মসজিদ উন্নয়নে সবই তার অবদান। এই ভাইয়ের মেজ ছেলে কামাল উদ্দিন দামুড়হুদা ওদুদ শাহ ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল। সাহিত্যিক হিসেবে এলাকায় যারা বহুল পরিচিত মৃত গোবরধন শাহ,কালু মল্লিক, আজিজুল মাষ্টার,আব্দুল আলীম ও শরীফ সাথী অন্যতম। প্রিয় পাঠক, আমার পিতা ডা: ওয়াজেদ আলী, তাই সে সুত্রে এ গ্রামের মানুষ হিসেবে আমিও দাবীদার।