মহেশপুরে পহেলা বোশেখ উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী চড়কপূজার মেলা শুরু

 

দাউদ হোসেন: মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর বকুলতলা বাজারে আজ শুক্রবার থেকে ৩ দিনব্যাপী  ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজার মেলা শুরু হয়েছে। ওই মেলার সভাপতি শ্রী সাধন কুমার ঘোষ জানান, দীর্ঘদিন ধরে এই চড়কপূজার উৎসব এখানে পালিত হয়ে আসছে। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এই উৎসব দীর্ঘদিন ধরে পালন করে আসছে তাই তাদের দেখাদেখি আমরাও এই উৎসবটি আনান্দের সাথে পালন করে থাকি। পহেলা বোশেখ থেকে মেলা শুরু হয়ে চলে তিনদিন ধরে। মেলার প্রধান আর্কষণ শেষ দিনে চড়কপূজা উপলক্ষে হিন্দু ধর্মীয় কিছু লোক সন্যাসী সেজে পিঠে লোহার বড়শি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে রসির সাথে বেঁধে ঘুরানো হয়। এবার একে একে ৬ জন সন্যাসীকে এই ভাবে পিঠে বড়শি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে ঘুরানো হবে। এবার যারা সন্যাসী সেজেছে বা পিঠে বড়শি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে উঠে ঘুরবেন তারা হলেন- শ্রী মনা কর্মকার, আনান্দ শর্মা রথিন দাস, বিপ্লব কর্মকার, অধীর হালদার ও ভীম কুমার। চড়ক পাক দেয়া হয় দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

মেলার সভাপতি আরও জানান, তারা এ চড়ক পূজায় সন্যাসীদের পিঠে বড়শি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে ঘুরানোকে চড়কপূজা হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। এবছর ১৬ এপ্রিল ৩রা বোশেখ রোববার সন্ন্যাসীদেরকে চড়ক গাছে ঘুরানো হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই মেলাটি দেখতে আসে। এমনকি পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই মেলা উপভোগ করতে এসে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এই মেলায় বিভিন্ন ধরনের দোকান পাসারী বসিয়ে মেলাকে জমজমাট করে তোলা হয়।

গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি শ্রী দুলাল ঘোষ বলেন, এই মেলা আগে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে শ্রী অমূল্য বাবু জজ সাহেবের জমিতে হাট খোলায় অনুষ্ঠিত হতো (বর্তমানে আশ্রয়ণ প্রকল্প করা হয়েছে)। এর পরে মহেশপুর চাঁদপুর মুচিপাড়ায় (বর্তমানে কাশেম চেয়ারম্যান বাড়ি করেছে) এবং বকুলতলা বাজারে অনুষ্ঠিত হতো। এই চড়ক পূজার মেলা কখন থেকে কিভাবে শুরু হয়েছে তার সঠিক কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে প্রবীণ হিন্দুরা মনে করেন, ৪-৫শ বছর আগে থেকে এই পূজা চলে আসছে। ব্রিটিশ আমলে ফতেপুরের জজ সাহেব শ্রী অমূল্য কুমার চট্রোপাধায়, কোলকাতা কলেজের অংক শাস্ত্রের শিক্ষাবিদ নগেন্দ্রনাথ মজুমদার, শ্রী মিলাম্বর মুখ্যোপাধ্যায়, কাশ্মীর মহারাজের মন্ত্রী পরে কোলকাতা মিউনিসিপ্যালের ভাইস চেয়ারম্যান নিবাচিত হন, পি মুখার্জী তৎকালীন ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভারসিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বঙ্গ দেশে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি চাকরি করেন। এই সকল ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময় এই মেলা পরিচালিত হতো। বর্তমানে এখানকার হিন্দুরা ভারতে পাড়ি জমানোর কারণে মেলাটি অদূর ভবিষ্যতে বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, সেন বংশের শাসন আমলে কাশ্মীর থেকে চড়ক পূজা শুরু হয়। সে সময় শিব ভক্ত একজন হিন্দু ব্যক্তি কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে তাকে বিভিন্ন উপায়ে রোগ সারানোর চেষ্টা করা হয়। পরে তার পিঠে বড়শি ফুঁটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে শিবকে পূজা করার পর তার রোগ মুক্তি হয়। সেখান থেকে এই চড়ক পূজার সৃষ্টি হয়েছে বলে এক ইতিহাস থেকে জানা যায়। তবে এ নিয়েও মতৈনক্য রয়েছে। আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই মেলাকে কেন্দ্র করে পুরা চৈত্র মাস পাড়ায় পাড়ায় বালাকি গান করতো। সন্ন্যাসীরা গভীর রাতে শীব পূজা করতো এবং সপ্তাহ ধরে ফল-ফুল্ললী খেয়ে জীবন ধারণ করতো। পূজা কমিটির লোকজন ঢাক-ঢোল বাজিয়ে মেলার ২-৩ দিন আগে ফতেপুরের কপোতাক্ষ নদ থেকে চড়ক গাছ তুলা হতো। বর্তমানে চড়ক মেলা ছাড়া অন্যা কোনো আনুষ্ঠানিকতা আর হয় না। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ক্রমান্বয়ে ভারত চলে যাওয়ায় মেলাটি আস্তে আস্তে ঐহিত্য হারিয়ে ফেলছে। পূজা কমিটির লোকজন এবারও বিপুল পরিমাণে লোক সমাগম হবে বলে আশা প্রকাশ করছে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সিরাজ জানিয়েছেন, এই উৎসব পালনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। এদিকে এ মেলাকে কেন্দ্র করে মহেশপুর থানার অফিসার ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম বিপ্লব জানান, পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।