মরার আগে মরতে রাজি নই

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পঁচাত্তরে বাবা, মা, ভাইসহ স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকেই মৃত্যু আমার পিছু ছুটেছে, কিন্তু আমি কখনো মৃত্যকে ভয় পাই না। এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে মাথা নত করি না। কারণ আমি জাতির পিতার কন্যা, এটা আমি সবসময় মনে রাখি। জন্মালে মৃত্যু হবে, তাই মরার আগে আমি মরতে রাজি নই। বার বার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমি বেঁচে আছি। আসলে আল্লাহ জন্ম দেয় কিছু কাজ করার জন্য। সেই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহই তাকে রক্ষা করে। আল্লাহ রক্ষা না করলে আমি ২১ আগস্ট প্রাণে বাঁচতে পারতাম না।

রক্তস্নাত ভয়াল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস উপলক্ষে গতকাল রোববার হামলার স্থল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের প্রতি আওয়ামী লীগ আয়োজিত শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। আগে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত অস্থায়ী শোকবেদীতে গ্রেনেড হামলায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্বজন এবং আহতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে নিহতদের স্বজন ও সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা ঘাতক গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে প্রাণে বেঁচে থাকা আহত নেতাকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রধানমন্ত্রী সবার শারিরীক অবস্থার খোঁজ-খবর নেন এবং তাদের সান্ত্বনা দেন।প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, দেশে আর যারা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের লালন পালন করে, যারা গ্রেনেড মেরে মানুষ মারে- তাদের স্থান বাংলার মাটিতে হবে না। এদের প্রতিরোধ করেই দেশের মানুষের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো। দেশবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এখনও নানা ধরণের চক্রান্ত চলছে। সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ নির্মূলে আমরা যখন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি, সেখানে তারা (বিএনপি) এসবে মদদ দিচ্ছে। নানা ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশ যখন সুষ্ঠুভাবে চলছে, কিছু বিদেশী শক্তি যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল তারা এখনো চক্রান্ত করছে। নানা ঘটনা ঘটাতে মদদ দিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন দেশই এখন নিরাপদ নয়। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বব্যাপী বড় ইস্যু এটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সম্প্রতি বাংলাদেশি ইমাম ও মুসল্লিকে হত্যা করা হয়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাজমুলসহ আরেকটি প্রদেশ কানেকটিকাতেও বাংলাদেশিকে হত্যা করা হচ্ছে।

গ্রেনেড হামলার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ তার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোটকে দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, এই হামলার আগে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া, তাদের জোটের নেতাদের বক্তব্য এবং বিএনপি নেত্রীর পুত্রের কর্মকান্ডই প্রমাণ দেয় এই ঘটনার জন্য কারা জড়িত। এটা নতুন করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা পুরো বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিলেও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে নাড়া দেয়নি। বরং তারা এই হামলার ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। তখন সংসদে বিএনপি নেত্রী ও তাদের দলের নেতারা বললেন গ্রেনেড হামলা নাকি আমরাই ঘটিয়েছি! আমি নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে মেরেছি। আমার প্রশ্ন- আমি কখন গ্রেনেড মারার প্রশিক্ষণ নিলাম? তারা সারা বাংলাদেশে রটালো এই ঘটনা আমরাই ঘটিয়েছি। তিনি বলেন, এতবড় মানবতা বিরোধী ঘটনার পর সংসদে আমাদের একটি কথাও বলতে দেয়নি বিএনপি সরকার। আমি তখন বিরোধী দলীয় নেতা। কি দুর্ভাগ্য, এই ভয়াবহ হামলা নিয়ে আলোচনা এমনকি একটি নিন্দা প্রস্তাব নিতেও দেয়া হয়নি সংসদে। এতেই স্পষ্ট হয় কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল।

শেখ হাসিনা বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে খালেদা জিয়া প্রকাশ্য একটি জনসভায় বলেছিলেন- প্রধানমন্ত্রী তো দুরের কথা, আমি কোনদিন বিরোধী দলীয় নেতাও হতে পারব না। এই বক্তব্যের বহির্প্রকাশ কিন্তু ২১ আগস্টে হয়েছে। আমাকে দুনিয়া থেকে সরে দিতে পারলেই আমি কোনদিন বিরোধী দলীয় নেত্রী হতে পারবো না- এটাই উনি বোঝাতে চেয়েছেন। আর হামলার আগে খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান ধানমন্ডি ৫ নম্বরে তার শ্বশুর বাড়িতে এক টানা ৯-১০ মাস ছিল। পহেলা আগস্ট ধানমন্ডি থেকে সেনানিবাসের বাসায় ফিরে যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির নেত্রীর পুত্র কেন এতোদিন শ্বশুর বাড়িতে ছিলো? সেখানে বসে ষড়যন্ত্র করতে সুবিধা হবে এ জন্যই?

২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন,  সেদিন একটা দুটো নয়, বৃষ্টির মতো ১৩টি গ্রেনেড ছুঁড়ে আমাদের সমাবেশের ওপর হামলা করা হয়। তিনি বলেন, ট্রাকে থাকা নেতাকর্মীরা মানবঢাল রচনা করে আমাকে রক্ষা করেন। এ সময় আমার চশমা খুলে পড়ে গেলে আমি দুরে কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমাকে রক্ষায় মানবঢাল রচনার সময় হানিফ ভাইয়ের ( ঢাকা প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ) মাথায় অসংখ্য গ্রেনেডের স্প্লিন্টার বিদ্ধ হচ্ছিলো। তার মাথা বেয়ে রক্ত আমার গায়ে পড়ছিলো। আমদের নিরাপত্তারক্ষীরা পাল্টা গুলি ছুঁড়ে। এতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।  তিনি বলেন, ওই দিনের ভয়াবহ এ হামলায় আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতাকর্মী মৃত্যুবরণ করেছে। অজ্ঞাত ছিল আরও দুই জন। এতবড় একটি ঘটনা ঘটল অথচ পুলিশ ছিল নিরব। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় আমাদের সভা-সমাবেশের প্রতিটিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে। অথচ হামলার দিন পুলিশের কোন নিরাপত্তা ছিলো না। আশেপাশের মার্কেট-অফিসের ছাদে নিরাপত্তার জন্য আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা পাহারার জন্য যেতে চাইলেও পুলিশ তাদের যেতে দেয়নি কেন? আমাদের সমাবেশে কোনই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। বরং পুলিশ নিরাপদে হামলাকারীদের সরিয়ে দিচ্ছিল। এতেই স্পষ্ট যে, ২১ আগস্ট হামলা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি ঘটনা ঘটলে সরকারের পক্ষ থেকে আলামত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং উদ্ধারকার্য পরিচালনা করা প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু উল্টো আলামত সংরক্ষণের পরিবর্তে একে একে সব ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সারাজীবনই বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছে। যেখানে জাতির পিতার মতো একজনকে হত্যা করতে পারে। যিনি স্বাধীনতা এনে দিলেন, আত্ম-পরিচয়ের সুযোগ দিলেন, বাঙালি হিসেবে একটা জাতির মর্যাদা দিয়ে গেলেন। একটি রাষ্ট্র ও পতাকা দিয়ে গেলেন তাঁকে পর্যন্ত এই মাটিতে হত্যা করা হয়েছে। তাই ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের গভীরতা মাথায় রেখেই সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যেভাবেই হোক বাংলার মাটি থেকে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ দূর করে শান্তি নিয়ে আসতে হবে।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রী-এমপিসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।