ভেজাল ওষুধের কারবারিরা ফের সক্রিয়

 

স্টাফ রিপোর্টার: সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ, উচ্চ আদালতের একের পর এক আদেশ এবং সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও বিপজ্জনক ওষুধ থেকে রেহাই মিলছে না। ফাঁকফোকর খুঁজে ব্যবসায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা বেশ কিছু ওষুধ কম্পানি। কোনো কোনো কম্পানি নিষিদ্ধ তালিকায় থাকা কিছু অ্যান্টিক্যান্সার ও হরমোন ওষুধ উৎপাদন করে বাজারেও ছেড়েছে। কেউ কেউ রীতিমতো সরকারি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে নিষিদ্ধ ওষুধ সরবরাহের তৎপরতা শুরু করেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো কোনো পর্যায় থেকেও এসব তৎপরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে নানা কৌশলে। এসব নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা হয়েছে সম্প্রতি।

গত বছর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভায় ৮৪ ওষুধ কম্পানির বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। কমিটি সেগুলো গ্রাহ্য করে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। সেই আলোকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০টি কম্পানির মূল লাইসেন্স এবং ১৪টি কম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক আইটেমের ওষুধের লাইসেন্স বাতিল করে। একই সুপারিশের ভিত্তিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর আলাদা করে টেকনো ড্রাগস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি ইউনিটের পেনিসিলিন ও সেফালোস্পরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিক্যান্সার এবং হরমোন জাতীয় ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করে দেয়। এর পর থেকেই টেকনো ড্রাগস নিষেধাজ্ঞা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে।

জানা যায়, নিষেধাজ্ঞায় পড়ে টেকনো ড্রাগস আদালতে যায়। এরপর উচ্চ আদালত গত ৩ এপ্রিল আগের আদেশে কিছুটা ছাড় দিয়ে সরকারকে পাঁচ সদস্যদের একটি কমিটি করে সংশ্লিষ্ট কম্পানিগুলোর বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে বলেন। কমিটি তাদের পর্যবেক্ষণের পর ওষুধ উৎপাদনকারীদের বিপক্ষে মত দিলে আদালত চিহ্নিত ২৮টি কম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক (পেনিসিলিন ও সেফালোস্পরিন), স্টেরয়েড, অ্যান্টিক্যান্সার ও হরমোনবিষয়ক ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধে নতুন করে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে রায়ের কপি পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে ঔষধ প্রশাসন মহাপরিচালককে পাঁচ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কমিটিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন প্রতিনিধিকে রাখতেও বলা হয়।

সূত্র মতে, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর গত ১৮ জুন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাউকে না রেখেই চার সদস্যের কমিটি গঠন করে। এ ঘটনায় ১০ জুলাই স্বাস্থ্যসচিব সিরাজুল হক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মাকসুদা ইয়াসমিনকে নোটিশ দেয় মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। সন্তোষজনক সাড়া না পেয়ে ১৭ জুলাই দুজনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করা হয়। ১৮ জুলাই উচ্চ আদালত চার সদস্যের কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করে স্বাস্থ্যসচিবকে কারণ দর্শাতে বলেন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার নির্দেশ দেন।

এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কমিটিতে লোক দিতে না চাওয়ায় তাদের বাদ দিয়েই মন্ত্রণালয় থেকে কমিটি করে দেওয়া হয়। তবে আদালতে মামলার পর ওই কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এখন আমরা আদালতের নির্দেশমতো আবারও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে চিঠি দেবো। টেকনো ড্রাগসের তৎপরতা বিষয়ে গোলাম কিবরিয়া জানান, ওই কম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞার পর সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে গঠিত আরেকটি উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি টেকনো ড্রাগ কম্পানির কারখানা পরিদর্শন রিপোর্ট দেয়। সেই অনুসারে তাদের আগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তবে পরে আদালতের নির্দেশ আসায় আগের নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে।

টেকনো ড্রাগসও দরপত্র দিল: বাতিলের আওতায় থাকা টেকনো ড্রাগস তাদের হরমোন আইটেমের একটি ওষুধের ৪৬ লাখ ভায়াল গত বছর জুনে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে সরবরাহ করে। এ নিয়ে পরে একাধিকবার তদন্ত হয়। এদিকে এরপর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের গুদামে এক অগ্নিকাণ্ডে ওই ওষুধসহ আরো অনেক কিছু পুড়ে গেলে আবারও ওষুধের প্রয়োজন দেখিয়ে সম্প্রতি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর দরপত্র আহ্বান করে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হরমোন আইটেম উৎপাদনে নিষেধাজ্ঞা থাকা টেকনো ড্রাগসও দরপত্র জমা দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনো ড্রাগসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ জালাল উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, আদালতের কাছ থেকে আদেশ পেয়ে আমরা মাত্র কয়েক দিনের জন্য কয়েকটি আইটেমের কিছু পরিমাণ ওষুধ উৎপাদন করেছিলাম। কিন্তু পরে যখন আবার আদালত তা বন্ধ করতে বলেন, আমরা আর কোনো উৎপাদনে যাইনি।

এদিকে রাজধানীর মিটফোর্ড, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে, মহাখালীসহ আরো কয়েকটি এলাকায় ওই কম্পানির নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা অ্যান্টি ক্যান্সার ওষুধ পাওয়া যায়। বাজারে নিষিদ্ধ ওষুধ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে টেকনো ড্রাগসের এই কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, সব ওষুধ বাজার থেকে তাত্ক্ষণিক তুলে নেওয়া যায়নি। তাই কিছু ওষুধ হয়তো থেকে গেছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দরপত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে টেকনো ড্রাগসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘বিষয়টি আমি নিজে দেখি না। এটি অন্য লোক দেখে। তাই এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।

টেকনো ড্রাগসের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক মাহাবুবুর রহমান জোয়ারদার বলেন, ‘আমরা আদালতের নির্দেশের বাইরে কিছুই করব না। দরপত্র জমা যে কেউ দিতে পারে। আমরা যাচাই-বাছাই করব। এ সময় কোন কোনটি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি গ্রহণযোগ্য নয়, সেটি বিচার করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো কম্পানির ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সেটি বাদ যাবে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এর আগে বহুবার আমরা যেসব কম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন কারণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি, সেগুলোর মধ্যে অনেকেই আবার নানা কৌশলে ছাড় পেয়ে যায়। তারা আগের মতো উৎপাদনেও ফিরে যায়; কিন্তু আমাদের কিছু করার থাকে না। কারণ আদালতের বাইরে আমাদের কিছু করা সম্ভব নয়।