ভাঙতেই হবে বিজিএমইএ ভবন

 

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় পরিবেশের ক্ষতি করে বেআইনিভাবে প্রায় দুই দশক আগে গড়ে ওঠা ১৬ তলাবিশিষ্ট বিজিএমইএ ভবন ভেঙে ফেলার চূড়ান্ত রায় এসেছে। এই ভবনটি অবৈধ ঘোষণা করে তা ভেঙে ফেলতে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএর আপিলের আবেদন গতকাল বৃহস্পতিবার খারিজ করে দিয়েছে প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ।

এর ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল রইলো এবং ভবনটি ভাঙতে আইনগত আর কোনো বাধা রইলো না বলে জানিয়েছেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ, যিনি এ মামলায় হাইকোর্টে অ্যামিকাস কিউরি ছিলেন। বিজিএমইএর আইনজীবী রফিক-উল হকও বলছেন, ভবনটি ভেঙে ফেলতে হবে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হাইকোর্ট বলেছিলেন বিজিএমইএ ভবনটি ভেঙে দিতে। আপিল বিভাগ এটি কনফার্ম করেছেন। তার মানে বিল্ডিংটা ভেঙে দিতে হবে। হাইকোর্ট রায়ে বলেছিলেন, বিজিএমইএ ভবনটি সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রামিত করবে। তবে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতের ব্যবসায়ীদের সমিতির এই ভবনটি ভাঙলে তা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ব্যারিস্টার রফিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা ভেঙে দিলে অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। কারণ অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে গার্মেন্টস শিল্পের ওপরে। আপিল বিভাগের এই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হবে কি-না, সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বিজিএমইএর এক আইনজীবী জানান।

তিনি বলেন, রিভিউ করবে কি করবে না, সে বিষয়ে বিজিএমইএর বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হবে। আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের আলোকে রিভিউর বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। আদালতে রফিক-উল হকের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কামরুল হক সিদ্দিকী বিজিএমইএর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও আইনজীবী মনজিল মোরসেদ উপস্থিত ছিলেন। হাইকোর্ট ২০১১ সালে এক রায়ে জলাধার রক্ষা আইন লঙ্ঘন করে হাতিরঝিলে গড়ে তোলা বহুতল ভবনটি ভাঙার নির্দেশ দেন। দুই বছর পর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তার বিরুদ্ধে আপিলের এই আবেদন করে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএর করা আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন (লিভ টু আপিল) খারিজ করে।

মামলার পূর্বাপর: মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১০ সালের ২ অক্টোবর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ বিষয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ডিএইচএম মুনিরউদ্দিন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৩ অক্টোবর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল দেন। রুলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এ রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এতে স্থগিতাদেশ চেয়ে করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৫ এপ্রিল চেম্বার বিচারপতি হাই কোর্টের রায়ের ওপর ছয় সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেন। পরে এ সময়সীমা বাড়ানো হয়।

২০১৩ সালের ১৯ মার্চ ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাইকোর্টের দেয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর ওই বছর ২১ মে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল করে। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে, দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। হাইকোর্ট বলেছে, ক্রেতাদের সঙ্গে ওই চুক্তি ছিলো বেআইনি। কারণ ওই জায়গায় ভবন নির্মাণ বা কোনো অংশ কারও কাছে বিক্রির কোনো অধিকার বিজিএমইএর ছিলো না। তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানতো বা তাদের জানা উচিত ছিলো যে, এ জমির ওপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। সুতরাং তারা কোনো ইন্টারেস্ট পাওয়ার দাবিদার নয়। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের শিল্পোদ্যোক্তাদের সমিতির এই ভবনের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে শক্তিশালী একটি মহলকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে এমন যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে বিজিএমইএর আইনের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিলো। তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯৮ সালে বিজিএমইএ তাদের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণের জন্য সোনারগাঁও হোটেলের পাশে বেগুনবাড়ি খালপাড়ের এ জায়গাটি নির্ধারণ করে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ টাকায় জমিটি কেনে। ওই বছরের ২৮ নভেম্বর ভবনটি তৈরির কাজ শুরু হয়।

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, অর্থাৎ যাদের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিলো, তারাই মোট ৬ দশমিক ২১ একর জমি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেয় একই বছরে, অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। পরে ১৯৯৮ সালে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ওই জমি একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে এর নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য বেআইনিভাবে প্রদান করে। অথচ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আদৌ ওই জমির মালিক ছিলো না।

ভবনটি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নকশা অনুযায়ী করা হয়নি বলে রাজউক বলে আসছিলো। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনও ভবনটি ভাঙার দাবি জানিয়ে আসছিলো।

পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণি বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য বেগুনবাড়ি খালের একাংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে এবং এতে এর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।