বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে গুচ্ছপদ্ধতি অনিশ্চিত!

 

স্টাফ রিপোর্টার: সরকার আন্তরিক থাকলেও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতিবাচক মনোভাবে ছয় বছর ধরে ঝুলে আছে গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি। এটি যদি এবারও বাস্তবায়ন না হয়, সেক্ষেত্রে এখন যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হবে। এতে তাদের আগের মতোই অহেতুক অর্থ, সময় ও শ্রম দিতে হবে। এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
আরও জানা গেছে, গুচ্ছপদ্ধতি চালু হলে ভর্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষকের বাড়তি অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ হবে। পাশাপাশি বন্ধ হবে অবৈধ ভর্তি। আর এ কারণেই স্বার্থান্বেষী মহল গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির বিপক্ষে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে হাল ছাড়েনি গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির প্রস্তাবক বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। চলমান এইচএসসি পরীক্ষাকে সামনে রেখে এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ফের উদ্যোগ নিতে তাগিদ দিয়েছে ইউজিসির উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ)।

জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি ব্যবস্থা চালু হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এই ভর্তি-সংস্কারের ব্যাপারে অনিচ্ছুক।

ইউজিসির সাবেক সদস্য এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, এই পদ্ধতি বাস্তবায়নে একমাত্র বাধা কিছু শিক্ষকের লোভ। কিছু শিক্ষক ভর্তি পরীক্ষা থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হন। তারা ভর্তি ফরম বিক্রি থেকে শুরু করে পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রণয়ন এমনকি ভর্তি সম্পন্ন পর্যন্ত জড়িত থাকেন। এতে করে কেউ কেউ বছরে ৭০-৮০ হাজার টাকা আয় করে থাকেন। এর বাইরে অবৈধ ভর্তিতেও জড়িত আছেন কেউ কেউ। অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা হলে তাদের ওই লাভটি বন্ধ হওয়ার আশংকা থেকে তারা এতে বাধা দিচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ফি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে এক ধরনের ভর্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের নাভিশ্বাস ওঠে। একজন শিক্ষার্থীকে পছন্দের বিষয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক ক্ষেত্রেই গড়ে ১০ থেকে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে দেখা যায়। এতে করে ফরম কেনা, যাতায়াত, অবস্থানসহ নানাভাবে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা প্রত্যেকের খরচ হয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দেশের ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ডজনখানেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই গড়ে প্রায় ৩ মাস ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে তাদের প্রচুর সময়, অর্থ, শ্রম ইত্যাদি বিনিয়োগ করতে হয়।

উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর স্নাতকে ভর্তি নিয়ে যে কেবল শিক্ষার্থীদেরই এই ত্রাহি অবস্থায় পড়তে হয় তা নয়, তাদের সঙ্গে অভিভাবকদেরও নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাতে হয়। তাই লাখ লাখ শিক্ষার্থী অভিভাবককে এই গভীর উদ্বেগ-উতকণ্ঠা থেকে মুক্তি দিতে সরকার অর্ধযুগ আগে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির একটি উদ্যোগ নেয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তা সফলতার মুখ দেখেনি।
দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক কর্মকর্তারা বলেছেন, গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা সময়ের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আপসে এটা কখনোই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তাই মন্ত্রণালয়কে নির্বাহী আদেশ জারি করে এটি বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন তারা।
সরকারি গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী, একই বৈশিষ্ট্যের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একই গুচ্ছে এনে একটি পরীক্ষার আয়োজন করে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের তাতে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়া। যেমন : যারা প্রকৌশল শিক্ষায় আগ্রহী তাদের জন্য বুয়েটসহ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, যারা কৃষি শিক্ষায় আগ্রহী তাদের জন্য কৃষি, যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় আগ্রহী তাদের জন্য এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একই গুচ্ছে এনে একটি অভিন্ন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ যেগুলো একই ধরনের, সেগুলোকে সাধারণ গুচ্ছে এনে একটি পরীক্ষার আয়োজন করা। এতে করে মাত্র চারটি পরীক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নিজেকে উপস্থাপন করতে পারবে। ফলে ৩৪টি পরীক্ষায় যেমন আলাদা করে অংশ নিতে হবে না, তেমনি ৩৪টি আবেদনের জন্য আলাদা ফরম কেনার জন্য অর্থও ব্যয় করতে হবে না।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ নিয়ে কোচিং বাণিজ্য হয়। এতেই বছরে অন্তত ৩২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে থাকে কোচিংবাজ চক্র। আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা আরও উন্নত করা দরকার। এ জন্য একটি রূপরেখা প্রণয়নেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ আইনে চলে। তাদের স্বায়ত্তশাসনকে সরকার সম্মান জানায়। তাই তারা যদি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্ত সরকারকে জানায়, তাহলে তা সরকার এবং জনগণের জন্য ভালো হয়।

ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী শুক্রবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, উচ্চশিক্ষা নিয়ে তারা ইতিপূর্বে যে কর্মকৌশল তৈরি করেছেন তাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সংখ্যা হ্রাসের বিষয়টি রয়েছে। বাস্তব প্রয়োজনকে সামনে রেখে এ নিয়ে হেকেপর পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের একাডেমিক বিষয়ে গবেষণা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ভর্তি পদ্ধতি নিয়ে ওই গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বিভিন্ন অনুষদের জন্য গুচ্ছ বা উপ-গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি কার্যক্রম চালুর পরামর্শ এসেছে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক শিক্ষা সচিবের সঙ্গে বৈঠকেও গুরুত্বারোপ করেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংস্কার নিয়ে ততকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে নিয়ে বৈঠক করেন। তাতে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির প্রস্তাব দেয়া হয় ভিসিদের। এ সময়ে কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব হওয়ার মতো জুজুর ভয় দেখানো হয়। মহাজোট সরকারে এলে ২০০৯ সালেও এ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ভিসিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেবার অবশ্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রাজি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তা নাকচ করে দেয়। কিন্তু সরকার হাল ছাড়েনি। ২০১০ সালে এটি নিয়ে ফের আলোচনা হলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাডেমিক কমিটি এবং সিন্ডিকেটে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্তের কথা জানাতে সময় নেয়। একইভাবে ২০১১ এবং ২০১২ সালও কেটে যায়। কিন্তু হতাশ হয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ষষ্ঠবারের মতো ভিসিদের নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ফের বৈঠক বসেন। দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবটি সরাসরি নাকচ করে দেয়। আর বড় অন্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তবের মারপ্যাঁচে ফেলে দেয়। আর বৈঠকে যোগ দেয়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই গুচ্ছভিত্তিক ভর্তির পক্ষে মতামত দেয়। এমনকি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অভিন্ন পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণাও দেয়। যদিও সিলেটের স্থানীয় বাসিন্দাদের বাধার মুখে সেটি শেষপর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই বৈঠকে যোগদানকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এটা ঠিক যে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে একটি সমঝোতায় আসার বাস্তব প্রয়োজন রয়েছে। একটি পরিবর্তনে যাওয়া দরকার। কিন্তু এটা চট করে হবে না। আগে এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে। পরে তা আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা করতে হবে। এরপরই সমন্বয়ের দিকে যাওয়া যাবে।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সদ্য বিদায়ী সভাপতি ও গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন জনস্বার্থে গুচ্ছভিত্তিক বা অনুষদভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা হওয়া উচিত। এর বাইরে আঞ্চলিক-বিবেচনায়ও হতে পারে। কেননা আজ একটি ছেলে দিনাজপুরে পরীক্ষা দিয়ে কালই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে পারে না। এটা মানবিকভাবে অসম্ভব। তিনি মনে করেন, ফের ভর্তি মৌসুম এলে এ নিয়ে একটা আলোচনা হতে পারে।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে সারাদেশে ২৪টি সরকারিসহ প্রায় ৭ ডজন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এগুলোতে একটি মাত্র ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়ে থাকে। এর বাইরে সারা দেশে প্রায় ৩শ কলেজে অনার্সের ভর্তি পরীক্ষাও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একসঙ্গে নিচ্ছে। এখানেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমে এসেছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ.আ.ম.স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা মেলানো যাবে না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯০টি বিভাগ রয়েছে। এগুলোর প্রকৃতি আলাদা। তবে তার সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, মেডিকেলে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবশ্যই পারবে। এতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা কেবল সদিচ্ছা আর সিদ্ধান্তের।