বাবুল আক্তারের সোর্স মুসা পরিকল্পনাকারী!

 

স্টাফ রিপোর্টার: পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে পুলিশের এক বড় সোর্সের নাম এসেছে। তার নাম মুসা। গত রোববার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমনটাই উল্লেখ করেছেন এই মামলায় গ্রেফতার হওয়া দুই আসামি ওয়াসিম ও আনোয়ার। তারা বলেছেন, মুসা পুলিশের অনেক বড় সোর্স। অনেক টাকার দেয়ার লোভ দেখিয়ে এক নারীকে খুন করতে তাদের নির্দেশ দেন মুসা। কিলিং মিশনে মুসাসহ সাতজন অংশ নিয়েছিলেন। বাকি ছয়জন হলো আবদুল নবী, আনোয়ার, ভাগিনা রাশেদ, কালু, শাহজাহান ও ওয়াসিম। অস্ত্রের জোগানদাতা ছিলেন হানিফুল হক ভোলা নামে একজন।

চট্টগ্রাম মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ তার খাস কামরায় ওয়াসিম ও আনোয়ারের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। ওয়াসিমের ১৪ পৃষ্ঠার এবং আনোয়ারের ১০ পৃষ্ঠার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। জবানবন্দিতে দুজনই মুসাকে মিতু হত্যার পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা বলে উল্লেখ করেন। মিতু হত্যার সাথে সোর্স মুসার জড়িত থাকার বিষয়টি রহস্যের জন্ম দিয়েছে। দুই আসামির জবানবন্দি নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না পুলিশ কর্মকর্তারা। জানা গেছে, পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবেই মুসার পরিচিতি। বাবুল আক্তারের সাথে মুসার কোনো বিরোধ ছিলো কি-না তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে এখনো আসামিদের জবানবন্দির কপি আসেনি। আসামিরা যদি তার নাম বলে থাকে তবে মুসাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’

কার কাছ থেকে মিতুকে হত্যার নির্দেশ পায় মুসা: আদালত সূত্র মতে জবানবন্দিতে ওয়াসিম ও আনোয়ার জানিয়েছেন, ঘটনার আগের দিন অর্থাত ৪ জুন রাতে সাতজন মুসার বাসায় বৈঠক করেন। সেখানে মুসা সবাইকে বলেন, মিতু জঙ্গিদের অর্থ সহায়তা করে। তাই তাকে মেরে ফেলতে হবে। তবে মুসা কার কাছ থেকে এই নির্দেশ পেয়েছেন তা কাউকে জানাননি। মিতুকে হত্যা করতে পারলে মোটা টাকার লোভ দেখানো হয়। এ সময় একটি রিভলবার ও একটি পিস্তল সরবরাহ করেন ভোলা। এ দুটি অস্ত্র গ্রহণ করে ওয়াসিম ও আনোয়ার বাসায় চলে যান। এরপর গভীর রাতে ভোলা বাসায় চলে যান। সকালে ভোলা রিকশা নিয়ে প্রবর্তক মোড়ে আসে। মুসা ও আরো একজন মোটরসাইকেল নিয়ে সেখানে আসেন। বাকিরা আসেন একটি সিএনজি অটোরিকশায়। মোট সাতজন প্রবর্তক মোড়ে আসার পর তারা হেঁটে হেঁটে গোলপাহাড় মন্দিরের কাছে যান। ওয়াসিম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে মিতু বাসা থেকে বের হচ্ছেন কিনা তা পর্যবেক্ষন করতে থাকেন। ওয়েলফুডের সামনে অবস্থান নেন আনোয়ার। অন্যরাও আশপাশে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। মিতু বাসা থেকে বের হওয়ার পর ওয়াসিম মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হয়ে ঘটনাস্থলের দিকে যেতে থাকেন (এই দৃশ্য ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে)। এরপর মুসা বিপরীত দিক থেকে মিতুকে মোটরসাইকেল দিয়ে ধাক্কা দেন। ঠিক তখনই নবী মিতুকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকেন। আর ওয়াসিম গুলি করেন।

গুলি আসলে করেছিলেন কে?: আদালত সূত্র জানায়, মিতুকে কে গুলি করেছিলেন, এ নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন দুই আসামি। আনোয়ার বলেন, মিতুকে প্রথম ছুরিকাঘাত করেছিলেন নবী। এরপর মিতুর মাথা লক্ষ্য করে গুলি করেন ওয়াসিম। গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে মিতুকে গুলি করার কথা স্বীকার করলেও জবানবন্দি প্রদানকালে তা অস্বীকার করেন ওয়াসিম। ওয়াসিম বলেন, এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তিনি শুধু ফাঁকা গুলি করেছিলেন। কিন্তু তার হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে মিতুকে গুলি করেছিলেন মুসা। ওয়াসিম আরো বলেন, মুসা পুলিশের অনেক বড় সোর্স।

মিতুর পরিচয় জানতেন না ওয়াসিম, আনোয়ার : ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়া জবানবন্দিতে দুই ঘাতক জানায়, তারা মিতুর পরিচয় জানতেন না। খুন করার পর বাসায় গিয়ে টিভিতে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী হত্যার খবর দেখতে পান তারা। আনোয়ার জবানবন্দিতে বলেন, ‘খুন করার পর বাসায় গিয়ে টিভিতে খবর দেখার পর খুব ভয় পেয়ে যাই। এ সময় মুসাকে মোবাইল করলে সে আমাকে এ বিষয়ে চুপ থাকতে বলে। মুসা বলে, আমি পুলিশের বড় সোর্স। তোদের কোনো সমস্যা হবে না। বেশি কথা বললে বিপদ হবে।

খুনীদের পা ধরে মায়ের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো শিশু মাহির: মিতুকে হত্যা করার সময় তার প্রাণভিক্ষা চেয়ে খুনীদের পা ধরে কান্না করেছিলো তার শিশুপুত্র আক্তার মাহমুদ মাহির। জবানবন্দিতে এমন তথ্যই দিয়েছেন গ্রেফতার হওয়া আনোয়ার। তিনি জানান, মিতুকে ছুরি মারার সময় প্রথমে নবীর পা জড়িয়ে ধরে মাহির। কান্না করে সে তার মাকে না মারতে অনুরোধ করে। এরপর সে একবার মুসার পা, আবার ওয়াসিমের পা জড়িয়ে ধরে তার মাকে ছেড়ে দিতে বলে। তবে আনোয়ার জাপটে ধরে রাখায় মাহির তার মায়ের কাছে ঘেঁষতে পারেনি। নিজের চোখের সামনেই মাকে নির্মমভাবে খুন হতে দেখে সাত বছর বয়সী ছেলে।

কে এই মুসা?: ডিবি সূত্র জানায়, কিলিং মিশনে অংশ নেয়া সাতজনই দুর্ধর্ষ অপরাধী। এর মধ্যে কামরুল ইসলাম ওরফে মুসা শিকদার চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাণীরহাট এলাকার খোয়াইল্ল্যা পাড়ার মৃত শাহ আলম শিকদারের বড় ছেলে। ছয় ভাই, তিন বোনের মধ্যে মুসা তৃতীয়। তার পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে কাটিয়ে ২০০০ সালে তিনি সে দেশে ফিরে আসেন। এসে বিয়ে করেন আপন চাচা পুলিশ কনস্টেবল ফারুক শিকদারের মেয়ে পান্না শিকদারকে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির সাথে সখ্য করে তোলেন তিনি। যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হাত ধরেই তার উত্থান। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে রাঙ্গুনিয়া এলাকায় অনেক অপকর্মের হোতা ছিলেন মুসা। এক পর্যায়ে ৱ্যাব, পুলিশের সাথেও সখ্য গড়ে ওঠে তার। এই সূত্রে বাবুল আক্তার হাটহাজারী সার্কেলের এএসপি হয়ে আসার পর তার সাথেও মুসার ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে কক্সবাজারে বদলি হয়ে যাওয়ার পরও মুসা বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবে ছিলেন। এ সময় মুসা রাঙ্গুনিয়া ছেড়ে চট্টগ্রাম মহানগরীর বাকলিয়া এলাকায় এসে আস্তানা গড়ে তোলেন। জড়িয়ে পড়েন অস্ত্র ও ইয়াবা ব্যবসায়। তার ছত্রছায়ায় রাঙ্গুনিয়ার ওয়াসিম, রাশেদ, আনোয়ার, আবদুল নবী, শাহজাহান ও কালুসহ কয়েকজন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী শহরে এসে অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ে।