বজ্রপাতে করণীয়

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে বজ্রপাত ও এর ফলে মানুষের মৃত্যুর হার বছর বছর বাড়ছে। গত দুই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রাঘাতে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে শিশু, ছাত্র, দিনমজুর ও কৃষক। গত ৩৫ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আবহাওয়া অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতের হার বেড়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর আবহাওয়া অনেক বেশি বিরূপ আচরণ করছে। এ বছর শীতের মেয়াদ ছিল অনেক কম। ৬ এপ্রিল থেকে টানা ২৬ দিন দেশে অস্বাভাবিক গরম ও তীব্র দাবদাহ হয়েছে। নতুন করে সংযোজন হলো বজ্রাঘাতে মানুষ মারা যাওয়ার হার বেড়ে যাওয়া।

বজ্রপাতের সময় পাকা বাড়ির নিচে আশ্রয় নিতে এবং খোলা জায়গা, জলাশয়, উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের  লাইন থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এ সময় জানালা থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি ধাতব বস্তু এড়িয়ে চলা, টিভি-ফ্রিজ না ধরা, গাড়ির ভেতর অবস্থান না করা এবং খালি পায়ে না থাকারও পরামর্শ দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।

একজন আবহাওয়াবিদ বলেন, ঘন ঘন বজ্রপাত হতে থাকলে খোলা বা উঁচু জায়গায় না থাকাই ভালো। সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনো দালানের নিচে আশ্রয় নেওয়া যায়। বজ্রপাত হলে উঁচু গাছপালা বা বিদ্যুতের খুঁটিতে বিদ্যুত্স্পর্শের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই বজ্রঝড়ের সময় গাছ বা খুঁটির কাছাকাছি থাকা নিরাপদ নয়। ফাঁকা জায়গায় যাত্রীছাউনি বা বড় গাছে বজ্রপাত হওয়ার আশঙ্কা থাকে অত্যন্ত বেশি।

বজ্রপাতের সময় বাড়িতে থাকলে জানালার কাছে গিয়ে উঁকিঝুঁকি নিরাপদ নাও হতে পারে। এ সময় জানালা বন্ধ রেখে ঘরের ভেতরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। অধিদফতরের কর্মকর্তাদের মতে, বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা ঠিক হবে না। এমনকি ল্যান্ড ফোন ব্যবহার না করাও ভালো। বজ্রপাতের সময় এগুলোর সংস্পর্শ এসে অনেকে স্পৃষ্ট হয়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্টের (আইডাব্লিউএফএম) অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম মনে করেন, মানুষ একটু সচেতন হলেই বজ্রাঘাতে মৃত্যুর হার অনেক কমে আসবে। তিনি বলেন, বজ্রঝড়ের সময় কেউ যদি নদী, খাল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, মাঠ, পুকুরের পাশে থাকে, সে যেন সেখান থেকে সরে যায়। এছাড়া খোলা জায়গা, গাড়ি ও টিনশেডের বাড়িতে যারা থাকে, তারাও যেন ওই সময় নিরাপদ স্থানে সরে যায়। সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর বজ্রাঘাতে মাত্র ২০ থেকে ৩০ জন মানুষ মার যায়। কারণ সেখানকার মানুষ সচেতন। তাদের কারিকুলামে বজ্রপাত নিয়ে আলোকপাত করা আছে। আমাদেরও উচিত পাঠ্যপুস্তকে বজ্রপাত বিষয়ে আলোকপাত করা।’

বজ্রপাতের কারণ সম্পর্কে আবহাওয়া অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ বলেন, মার্চ থেকে মে এই তিন মাস উষ্ণতম মাস। এ সময়ে বায়ুতে অস্থিরতা বিরাজ করে। এ সময়ে বঙ্গোপসাগর থেকে আসে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু। এ বায়ুতে জলীয় বাষ্প বেশি থাকে। অন্যদিকে উত্তর ও পশ্চিম দিক অর্থাৎ হিমালয় এলাকা থেকে আসে শুকনো ও ঠাণ্ডা বায়ু, যাতে আর্দ্রতা কম থাকে। এ দুটির মিশ্রণে কালো মেঘের সৃষ্টি হয়। তখন মেঘের ঘনত্ব বাড়ে। একই সাথে মেঘের আকারও বড় হয়। এ সময় দুই ধরনের বায়ুর মধ্যে ঘর্ষণ হয়। ওই ঘর্ষণের ফলেই বজ্রপাত হয়। এক কথায় বলা যায়, মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে ধ্বন্যাত্মক ও ঋণাত্মক প্রতিক্রিয়ায় বজ্রপাত হয়।

অনেকে আবার বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার পেছনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াকেও দায়ী করছেন। ২০১৪ সালে বিখ্যাত জার্নাল দ্য সায়েন্সে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের হার ১২ শতাংশ বাড়ে। আর এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বজ্রপাতের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে ডেভিড রমসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

স্থানীয় আবহাওয়াবিদরাও বলছেন, বাংলাদেশে বর্ষার আগে তাপমাত্রা বাড়ছে। এতে মাটির তাপমাত্রাও বাড়ছে। ফলে ওই সময় বায়ু অস্থির হয়ে ওঠে। এ কারণে শক্তিশালী লঘুচাপ সৃষ্টি হয়।

তবে বজ্রপাত ও পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন এমন একজন সাংবাদিক বজ্রপাতের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর ‘বিপন্ন পৃথিবী : জলবায়ু ও জীবন’ গ্রন্থে। বইটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বজ্রপাত নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও উন্নত বিশ্বে এ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে বিস্তর। এসব গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বায়ুদূষণের সঙ্গে বজ্রপাতের নিবিড় সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। গবেষকরা লক্ষ করেছেন, বজ্রপাত একদিকে যেমন বাতাসে দূষণের মাত্রা বাড়াচ্ছে, তেমনি আবার বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে বজ্রপাতের হার ও তীব্রতা। এ যেন দূষণের এক নয়া দুষ্টচক্র।

টেক্সাসের অ্যাঅ্যান্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানীর গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে ওই সাংবাদিক বলেন, ‘নাসার কারিগরি সহায়তায় উপগ্রহের সাহায্যে গবেষণা চালিয়ে দেখতে পেয়েছেন, বজ্রপাতের পর পরই ট্রপসফিয়ারে (বায়ুমণ্ডলের সর্বনিম্ন স্তর) প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন অক্সাইড (নাইট্রিক অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড) তৈরি হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইড বা কার্বন মনোক্সাইডের চেয়েও বিষাক্ত এ নাইট্রোজেন অক্সাইড রূপান্তরিত হয়ে যায় ওজোন গ্যাসে। সেই গ্যাস বাতাসের এমন একটি স্তরে জমে থাকছে যে এর ফলে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এই বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণাপত্রে বলেছেন, ‘বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট দূষিত অক্সাইড পরিবেশ দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যানবাহনের কারণে দূষণ বা শিল্পজনিত দূষণের চেয়ে বজ্রপাতজনিত দূষণের মাত্রা অনেক বেশি।’ ওই গবেষকদলের প্রধান ড. রেনি ঝাংকে উদ্ধৃত করে বইটিতে বলা হয়েছে, বজ্রপাত যেমন বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়াচ্ছে, তেমনি আবার বায়ুদূষণের ফলে বাড়ছে বজ্রপাতের হার।