ফ্রান্সে উদযাপনের ভিড়ে ট্রাক নিয়ে হামলা : নিহত ৮৪

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় নিস শহরে বাস্তিল দিবসের উৎসবে জড়ো হওয়া জনতার ওপর দ্রুত গতিতে ট্রাক চালিয়ে দেয়ার ঘটনায় শিশুসহ অন্তত ৮৪ জন নিহত হয়েছেন; এ ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা বলছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার রাতের এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও প্রায় অর্ধশত মানুষ। পুলিশ চালককে গুলি করে হত্যা করে ট্রাক থামিয়েছে।

খবরে বলা হয়, বাস্তিল দিবস উদযাপন করতে বহু লোক ওই সময় শহরের ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বিখ্যাত প্রমেনেদ দেজাঙ্গলে চত্বরে জড়ো হয়েছিলেন। আতশবাজির প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পরপরই স্থানীয় সময় রাত ১১টার দিকে সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ২৫ টন ওই ট্রাক প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা এগিয়ে যায়। স্থানীয় সরকারের প্রধান ক্রিস্তিয়ান এসত্রোসি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, পুলিশ গুলি চালানোর আগে ওই ট্রাকচালকই গুলি করে। ওই ট্রাকে অস্ত্র ও গ্রেনেডও পাওয়া গেছে। প্যারিসে ইসলামি স্টেট জঙ্গিদের হামলায় ১৩০ জন নিহত হওয়ার আট মাসের মাথায় ফ্রান্সজুড়ে জরুরি অবস্থার মধ্যেই এ ঘটনা ঘটলো। একজন হামলাকারীই নিসের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী প্রাথমিকভাবে হামলার দায় স্বীকার না করলেও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া অলন্দ একে সন্ত্রাসী হামলা বলেছেন। ফ্রান্স এখন ইসলামী সন্ত্রাসবাদের হুমকির মুখে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, এর বিরুদ্ধে লড়তে সম্ভব সব কিছুই আমাদের করতে হবে। নিসে হামলার পর জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশের সন্ত্রাস দমন ইউনিটকে এ ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

হামলার ঘটনার পরপরই শহরের মেয়র ক্রিস্তঁ এস্তরোসি টুইট করে নিসবাসীকে সতর্ক করেন। বাসিন্দাদের বাড়ির ভেতরে থাকার পরামর্শ দেন তিনি। হামলা যখন হয় সেই সময় আতশবাজির প্রদর্শনী শেষে সঙ্গীত অনুষ্ঠান শুরু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তিনি গুলির শব্দও শুনেছেন। প্রথমে আতশবাজির শব্দ মনে করলেও পরে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তিনিও অন্যদের মতো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়াতে থাকেন। স্থানীয় এক টিভিকে আরেকজন বলেন, ঘটনার পর সবাই রান রান বলে চিৎকার করছিলো। সবাই চিৎকার করছিলো আর বলছিলো হামলা হয়েছে। আমরা গুলির শব্দও শুনি। তবে ভেবেছিলাম সেগুলো আতশবাজির শব্দ, কারণ আজ ১৪ জুলাই। বাস্তিল দিবস উদযাপন করতে সেখানে হাজারেরও উপর মানুষ জড়ো হয়েছিলেন বলে এক সাংবাদিক জানান। টুইটারে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, বহু মানুষ রাস্তার ওপর পড়ে আছে। দিশেহারা হয়ে ছোটাছুটি করছে আতঙ্কিত মানুষ।

ইউটিউবে আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, চারদিকে উচ্চ লয়ের বাজনা আর উৎসবের আমেজের মধ্যে শাদা রঙের ভারী ওই ট্রাক হঠাৎ দ্রুত গতিতে এসে জনতার ওপর উঠে পড়ে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ট্রাকের গতি কমে এসেছে এবং পুলিশ সেটি থামানোর চেষ্টা করছে।

নিস মাতাঁ নামের একটি স্থানীয় পত্রিকার এক সাংবাদিক জানান, পুরো এলাকা রক্তে একাকার হয়ে হামলাকারী চালক তিউনিসিয়ান বংশোদ্ভূত ফরাসী এবং তার বয়স ৩১ বছর বলে এক সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে। চালক ছাড়া আর কেউ এ ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন কী না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র পিয়েরে অঁরি ব্রাদেঁত। ঘটনার পর কয়েকজনকে জিম্মি করার গুজব ছড়িয়ে পড়লেও তিনি তা নাকচ করেন এবং জানান ঘাতক ড্রাইভারকে নিস্ক্রিয় করা হয়েছে। হামলার পর পুলিশ বেষ্টিত ট্রাকের যেসব ছবি সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে উইন্ড শিল্ডজুড়ে অসংখ্য গুলির দাগ দেখা যায়। ঘটনার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক রেস্তোরাঁ মালিক জানিয়েছেন তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। আমি দেখছিলাম মানুষ দৌড়াচ্ছে। তারপর ট্রাকটি থেমে গেলো। আমরা মাত্র পাঁচ মিটার দূরে ছিলাম। এক নারীকে দেখলাম তার সন্তানকে খুঁজছে। তার ছেলে মাটিতে পড়ে আছে, তার শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছে। এর আগে ইসরায়েল ও ইউরোপের কয়েকটি স্থানে গাড়ি নিয়ে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলেও এতো ব্যাপক হতাহতের ঘটনা আর ঘটেনি। ইসলামিক স্টেটের হামলার পর ফ্রান্সের দিবস ও বড় বড় জমায়েতগুলোতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছিলো। তবে নিসের ওই চত্বরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছু সময় শিথিল ছিলো বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাড়ে তিন লাখ অধিবাসীর শহর নিস পর্যটন ও জাঁকজমকপূর্ণ রিসোর্টের জন্য বিখ্যাত। সম্প্রতি এ শহরের বেশ কয়েকজন মুসলিম অধিবাসী ইউরোপের অন্য দেশ হয়ে সিরিয়া গেছেন বলে গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন। তারা জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটে যোগ দিতে পারেন বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। এই জায়গা এবং বাস্তিল দিবস, কোনোটাই কাকতালীয় নয়,  বলেন সাবেক ফরাসি গোয়েন্দা ‍ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ক্ল মনিক।

১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় বাস্তিল দুর্গের পতনের বার্ষিকীতে প্রতি ১৪ জুলাই জাতীয় দিবস পালন করে দেশটি। বাস্তিল দিবস উপলক্ষে দেয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট অলন্দ গত আট মাস ধরে জরুরি অবস্থা বজায় রাখার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে জরুরি অবস্থা তুলে নেয়ার ইঙ্গিত দেন।  কিন্তু নিস শহরে হামলার পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও তিন মাস বাড়ানোর ঘোষণা দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র নেড প্রাইস জানান, তাদের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিসের ঘটনা নিয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছেন। তার উপদেষ্টারাও তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক টুইটারে বলেন, নিসের এ ঘটনা দুঃখজনক ও স্ববিরোধী, কারণ মানুষ তখন সাম্য-মৈত্রী আর ভ্রাতৃত্বের দিবস উদযাপন করছিলো।