ফুটবলের জন্য সিংহাসন হারাতে পারেন দিলমা

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: প্রেমের জন্য সিংহাসন বলির ঘটনা আছে। এবার ফুটবলেরজন্য সিংহাসন হারাতে পারেন ব্রাজিলের নির্বাচিত রানী দিলমা রুসেফ। তিনিইদেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আবারও প্রেসিডেন্ট হবেন এমনধারণায় বিশ্বকাপের
আগে বাতাস তীব্র ছিলো সেটায় এখন ভয়ানক টান পড়েছে।গার্ডিয়ান লিবার্টি ভয়েসের কার্টনি অ্যান্ডারসনের মতে ‘ডাচরা ব্রাজিলেরকাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়েছে’।

ব্রাজিলের বিরোধীদল প্রেসিডেন্ট দিলমারুসেফের কঠোর সমালোচনায় ফেটে পড়েছেন। জার্মানির সঙ্গে সাত গোল, যাকেস্কলারি বলেছিলেন, পাঁচ মিনিটের টর্নেডো, এখন ডাচরা তাদের তিন গোলে এতটাঅপমানজনকভাবে হারিয়ে দেয়ার পর আর আকস্মিক বা দৈবাৎ বিপর্যয় বলার আর কোনসুযোগ থাকলো না। সত্যি ব্রাজিলের এমন একটি ক্ষয়রোগে ধরেছে যা সহজেনিরাময়যোগ্য নয়। তবে আপাতত প্রেসিডেন্ট দিলমা তোপের মুখে পড়েছেন। নিউ ইয়র্কটাইমস লিখেছে, বিরোধী দলীয় সিনেটর বলেছেন, দিলমা রুসেফ বিশ্বকাপেররাজনীতিকীকরণ করেছিলেন। ভয়েস অব রাশিয়া বলেছে, ‘ব্রাজিলের মহাকাব্যবিশ্বকাপে পরাস্ত, এখন রাষ্ট্রপতির পদ খুইয়ে মাশুল দেবেন দিলমা।’ অবশ্য সাওপাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যাঞ্জেলো সেগেরেইলো বলেন, নির্বাচন হবে অক্টোবরে। তখন অন্যান্য ফ্যাক্টর আরও বড় হয়ে দেখা দেবে। তবেএই মুহূর্তে দিলমাকে সাফাই বক্তব্য দিতে হচ্ছে। বলতে হচ্ছে ফুটবলের সঙ্গেরাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে যুক্তি দিয়েছেন, ‘দেখুন, ফুটবলের বিপর্যয়ে আমি ততটাই যাতনা সইছি প্রত্যেক ব্রাজিলীয় সহ্যকরেছেন যতোটা।’ তবে বিশ্বকাপে জয়-পরাজয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না। কারণইতিহাস তা বলে না। ২০০২ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জয়ী হয়েছিলো। কিন্তু তখনকারপ্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্রাটরা হেরেছিলেন। আবার ১৯৯৮সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিল যখন ফ্রান্সের সঙ্গে হেরে গেল, তখনক্ষমতাসীন ফার্নান্দো হেনরিক কার্দোসো পুনঃনির্বাচিত হলেন।

এসবই সত্য।কিন্তু বাংলাদেশের চায়ের দোকানের লোকও এক বাক্যে বলবেন, ব্রাজিল এবারে যাকরেছে এর নাম জয়-পরাজয় নয়। গতকাল ঢাকার টিভি চ্যানেলগুলোতে একাধিকপ্রতিক্রিয়ায় তরুণ-তরুণীরা বলছেন, এত বড় আঘাত আর ধারণ করতে পারছি না।ব্রাজিল একটিও গোল দিতে পারবে না। তা-ও আবার তিনটি গোল খাবে সাত গোল খাওয়ারপরে। এটা তো কোনভাবেই সাধারণ জয়-পরাজয় নয়। সাধারণ কোন বিস্ময় নয়। তাছাড়া, দিলমা যে দুটো উদাহরণ দিয়েছেন তখন ব্রাজিল স্বাগতিক দেশ ছিলো না। প্রায় ১২বিলিয়ন ডলার খরচ করে আসর পাতেনি। বিরাট অপচয়ের অভিযোগ সরকারগুলোর উপর ছিলনা। ব্লুমবার্গকে জিওফ্রি ডেনিস বলেছেন, এমন লজ্জাজনক পরাজয়ে ব্রাজিলীয়দেরমানসিকভাবে পীড়িত মনে হচ্ছে। স্টক মার্কেটে দারুণ ধস নেমেছে।

কিন্তুকোটি টাকা দামের প্রশ্ন হলো কেন ইতিহাসের এই নিকৃষ্টতম পরাজয়?জার্মানট্যাংক কি করে ব্রাজিলকে চিড়েচ্যাপ্টে করে দিলো। খেলায় হারজিত থাকবে।কিন্তু এটা বুঝতে ফুটবল পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই যে, গত দু’টো খেলায়ব্রাজিলীয় খেলা হয়নি। তাই কোনো হারজিতের প্রশ্ন ছিলো না। ঘানা ও ব্রাজিলেরউইচ ডক্টরদের কথাই দেখা যাচ্ছে সত্যি হয়ে গেলো। কোনো অতিশয় বিজ্ঞানমনস্ক লোকওএখন ভাবতে পছন্দ করবেন যে, ক্রুদ্ধ উইচ ডক্টররা সবাই মিছিল করে ব্রাজিলেজড়ো হয়েছিল। আর তারা তাদের সম্মিলিত তুকতাক মন্ত্র দিয়ে সেলেকোদের ফ্রিজকরে দিয়েছে। ওঁরা জার্মানদের পরে ডাচদের সঙ্গেও স্থাণুর মতো দাঁড়িয়েছিলো।

পেলেএর আগে খেলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টুইট করেছেন। বলেছেন ‘আমি সব সময় বলিফুটবল হচ্ছে বিস্ময়ের বাক্স। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপে  ব্রাজিল ট্রফি জিতবে।’ কিন্তু ডাচদের সঙ্গে খেলার পরে পেলে বরং মেসির চেয়েওতাঁর চুল ঘন ছিল এমন মন্তব্য করেছেন। প্রেসিডেন্ট দিলমা অবশ্য ঠিকইবলেছেন, সেটা আরও বহুকাল আলোচনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে থাকবে।
তবেপ্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফের রাজনৈতিক এজেন্ডা ও তাঁর শাসনগত বা অনেকের মতেঅপশাসনগত চাপ নেইমারদের ওপরে কতটা কি পড়েছিল সেই প্রশ্ন একদিন আসবে।স্কলারি, যিনি বলেছেন, আমি খেলার পরিকল্পনাজনিত ত্রুটির দায় স্বীকার করছি।কিন্তু দায়দায়িত্বটা  রুসেফের কাঁধ পর্যন্ত স্পর্শ করতেই পারে সেটা এখনস্পষ্ট। কারণ স্বাগতিক দেশ হয়ে  ব্রাজিল বিতর্কের কেন্দ্রে অনেক আগেইএসেছিল। শুরুটাই ছিল তর্ক, উত্তেজনা ও সংঘাতপূর্ণ। রুসেফ সরকারের বিরুদ্ধেধর্মঘটী শ্রমিকদের ক্ষোভ জবরদস্তি প্রশমিত হয়েছিল। কিন্তু সেই ক্ষোভ ধিকিধিকি জ্বলছে।

এখন প্রশ্ন উঠছে, কেন নেইমাররা এত কেঁদেছিলো?  প্রেসিডেন্টরুসেফের রাজনৈতিক ওজন কি কোনভাবে জাতীয় টিমের ওপর চেপে বসেছিলো?রুসেফনির্বাচনে যাচ্ছেন। আর তাই তাঁর আয়োজনে করা বিশ্বকাপের বিতর্কিত অধ্যায়টাতিনি টিমের বিজয় দিয়ে পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলেন কি?গত কয়েক দিন ধরেই এটালক্ষ্য করা যাচ্ছিল যে, নেইমারদের নানা বিপর্যয়ের প্রসঙ্গে কেন জানি রুসেফএসে যাচ্ছিলেন। গত ৬ই জুলাই লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে জো লেহি যেপ্রতিবেদনটি লেখেন তার শিরোনাম ছিলো, ‘ব্রাজিল পোলস সিগনাল নেইমার ফ্রাকচারইজ আনলাইকলি টু হার্ট রুসেফ।’ ইতোমধ্যে নেইমারের চেয়ে রুসেফের রাজনৈতিকক্যারিয়ার ফ্র্যাকচারড হওয়ার লক্ষণ ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছে আসন্ন নির্বাচনেরুসেফকে এই গ্লানির কড়া মাশুল দিতে হবে। নেইমারকে রুসেফ লিখেছিলেন, ‘প্রিয়নেইমার, তোমার আঘাত দেখে আমার হূদয় ভেঙেছে। কেবল আমার নয়, গোটাব্রাজিলবাসীর হূদয় ভেঙে খান খান হয়েছে। কিন্তু আমি তোমার বীরোচিত অঙ্গীকারদেখে অত্যন্ত অভিভূত হয়েছি, কারণ কোন বীর আহত হলেও হার মানে না।’ কিন্তুকারও নজর এড়ায়নি যে, কেবল নেইমার নন, ব্রাজিলের পুরো টিম মাঠে কান্নায়গড়াগড়ি খেয়েছে। রুসেফ সম্ভবত আঁচ করেছিলেন। তাই তিনি ব্রাজিল টিমকে পৃথকবার্তায় বলেছিলেন, ‘বাছারা ভেঙে পড়ো না। লড়াইটা চালিয়ে যাও। আমাদের সমগ্রজাতি অত্যন্ত আগ্রহভরে তোমাদের বিশ্বকাপ ক্যাম্পেন লক্ষ্য করছে।

স্টেডিয়ামেরগ্যালারিতে শার্টে লেখা থাকে, ‘ফোরা দিলমা (দূর হও দিলমা)।’ মাঠে নেইমারসহআরও চার তারকার হাপুস নয়নে কান্না দেখে খোদ স্কলারি সাইক্রিয়াটিস্টডেকেছিলেন। তারা ভীষণ মানসিক চাপে ছিলেন। তারা মাত্রাতিরিক্ত ফাউলও করেছেন।এটাও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকেই সামনে আনে। জার্মান কোচ জোয়াকিমলো এদিকে ইঙ্গিত করেই মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, ‘আবেগে ভাসতে থাকা সেলেকোদেরজার্মানরা দাবড়ে বেরিয়েছে।’

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে,  ইউরেশিয়াগ্রুপের হোয়াও অগাস্তো দ্য কাস্ত্রো নেভেসের মতে কোনো ক্ষমতাসীনপ্রেসিডেন্টকে পুনরায় নির্বাচনের ম্যান্ডেন্ট পেতে হলে শতকরা ৪০ ভাগ ভোটপাওয়া দরকার। কিন্তু দিলমা সর্বশেষ জনমত জরিপে ৪০ ভাগের বেশি পেয়ে এগিয়েছিলেন। ব্রাজিলীয় জনমত জরিপকারী আইবোপ সর্বশেষ জরিপে দেখিয়েছিল রুসেফেরপ্রতি ম্যান্ডেট ৪৪ ভাগ। নেভেস মন্তব্য করেছিলেন, সেমিফাইনালটা উতরাতেপারলেই হলো। নেইমারের প্রস্থানে রুসেফ আহত হবেন না। সেই নেইমার রাতারাতিঅপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন। এমনকি তাঁর ছবিতে কালি মাখানো হয়েছে। তাঁর পোস্টারসাইজ ব্যানার রাস্তায় গড়াগড়ি খেয়েছে।
২৪ বছর বয়সী বায়োলজির ছাত্রী বেথআরুজা মন্তব্য করেন, ‘এভাবে পরাজয়ের গ্লানি গলাধঃকরণ বিব্রতকর। তবে একটাসান্ত্বনা আছে। প্রেসিডেন্ট দিলমার পুনঃনির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা এর ফলেক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য আমাদের সকল রাজনৈতিক দলই জাতীয় টিমের চেয়েও খারাপ।’ এর আগে পেলে-ও বিশ্বকাপ আয়োজনে বিশাল অপচয়ের জন্য দিলমার সমালোচনাকরেছিলেন। এএফপির এক রিপোর্ট মতে, রুসেফের প্রতি জনতা এখন বিদ্রূপ করছেন।এর অর্থ হচ্ছে গত বছর ব্রাজিলীয়রা অধিকতর উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাসুবিধার দাবিতে এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, সেই উত্তেজনাটা এখনও রয়েগেছে। দর্শক শ্রোতা দিলমার সামনেই তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রূপপূর্ণস্লোগান দিয়েছে। মিডিয়া সে সব অশ্লীল শব্দ প্রকাশ করার যোগ্য ভাবেনি।

নিউইয়র্ক টাইমসে সাইমন রোমিরো ১১জুলাই মানে ডাচদের সঙ্গে খেলার আগেইলিখেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে দিলমার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাসিও নেভেসএবং তাঁর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলীয় রানিং মেট অলিসিও নানস দাবি করেছেন যে, বিশ্বকাপ রাজনীতিকীকরণের জন্য রুসেফকে মূল্য দিতে হবে।’সাও পাওলোর সিনেটরনানস জার্মানদের সঙ্গে পরাজয়ের পরে রিপোর্টারদের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট রুসেফ ব্রাজিলীয় জনগণের আশাবাদের ওপর একটি পর্যটনের পরিকল্পনাকরেছিলেন। এখন আপনারা অপেক্ষা করুন এবং দেখুন। দিলমা নির্বাচনের আগে কাপেরকথা আর মুখেও নেবেন না।’