পোস্টমর্টেম শিক্ষা ছাড়াই ডাক্তার হচ্ছেন ৫৬ শিক্ষার্থী

যশোর মেডিকেল কলেজে শিক্ষক ফাঁকিবাজি রুখতে স্মারকলিপি

 

স্টাফ রিপোর্টার: শিক্ষকদের অফিস ফাঁকির সুযোগ দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টি ও উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে যশোর মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন যশোরের সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ।

গতকাল জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছে লিখিত এ অভিযোগ দেয়া হয়। এদিকে তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া গেছে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা গত ৫ বছরে পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা যেনতেনভাবে পেলেও ব্যবহারিক শিক্ষা যা পেয়েছেন তা দিয়ে কর্মজীবনে ডাক্তারি করতে পারবেন কি-না সে ব্যাপারে সন্দিহান রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে এমনই হতাশার খবর পাওয়া গেছে। মেডিকেল শিক্ষা কারিকুলাম তোয়াক্কা না করেই শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা দিয়েই দায় সারতে চাইছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের আস্কারাতেই শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণার এ ধারাটি সবচেয়ে বেশি অব্যাহত রেখেছেন ফরেনসিক মেডিসিন (লাশের ময়নাতদন্ত করার কাজে নিয়োজিত) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) ডাক্তার এবিএম নাজমুল হুদা।

যশোর মেডিকেল কলেজে ৫টি ব্যাচে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৮৬ জন। মেডিকেল শিক্ষা কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষ থেকে ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকের পাঠদান পাবেন। তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাদের ব্যবহারিক শিক্ষা দিতে হবে। মেডিকেল শিক্ষাক্রমে ফরেনসিক বিভাগের ব্যবহারিক শিক্ষার নামটি বলা হয় অটপসি। এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে টানা ১৫ দিন মর্গে উপস্থিত রেখে লাশের ময়নাতদন্ত বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিতে হবে। এছাড়াও শিক্ষার্থীরা মানুষের দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জনসহ মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়ার বিষয়ে শিক্ষা পান। অথচ যশোর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের ব্যবহারিক শিক্ষা থেকে পুরোপুরিই বঞ্চিত।

২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হওয়া ৫৬ শিক্ষার্থীর মেডিকেল শিক্ষা শেষ হচ্ছে আগামী ডিসেম্বরে। তারা সকলেই এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করে ডাক্তার হবেন। শিক্ষার্থীদের দুর্ভাগ্য, পাঠ্যপুস্তকে ময়না তদন্ত ও মানুষের মৃত্যুর কারণ উৎঘাটন পদ্ধতি সম্পর্কে তারা যেনতেন শিক্ষা পেয়েছেন, কিন্তু পাননি হাতে কলমে ব্যবহারিক শিক্ষা। ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের শিক্ষকরা প্রয়োজন বোধ করেননি মর্গে নিয়ে তাদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে। আসছে দিনের নতুন ডাক্তার হতে যাওয়া ৫৬ জন শিক্ষার্থীই এক্ষেত্রে অন্ধকারে রয়ে গেলেন। তাদের কিছুই করার নেই। অসম্পূর্ণ শিক্ষা নিয়ে তারা ভবিষ্যতে কি করবেন তা নিয়ে অভিভাবক মহলে দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

মেডিকেল কলেজে আরো ৪টি বর্ষের মধ্যে নতুন তৃতীয় বর্ষে ৫৭ ও পুরাতন তৃতীয় বর্ষে আরো ৫৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এদের মধ্যে পুরাতন তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা মর্গে গিয়ে লাশের ময়না তদন্ত সম্পর্কে দায়সারা ব্যবহারিক শিক্ষা পেয়েছেন। নতুন তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের মর্গের ব্যবহারিক শিক্ষা পাননি। বর্তমানে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে কর্মরত প্রভাষক ডাক্তার হুসাইন শাফায়াত ও ডাক্তার মাসফিকুর রহমান (দু’জনই জেনারেল সার্জারি বিষয়ে লেখাপড়া করছেন) শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষা দিচ্ছেন। যথাযথ শিক্ষা দিতে না পেরে শিক্ষক দু’জনই অতৃপ্ত।

ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডাক্তার এবিএম নাজমুল হুদা নিয়মিত অফিসে আসেন না। তাই শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ডাক্তার নাজমুল যশোর মেডিকেল কলেজে যোগদানের পর মাত্র একদিন মর্গে ঢুকেছেন। ২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি ডাক্তার শামারুখ মাহজাবিন শামা’র লাশের পুনঃময়না তদন্তের কাজে বোর্ড প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাও আবার আদালতের নির্দেশনায়। এরপর আর কোনদিনই তাকে মর্গের আশপাশে দেখেননি শিক্ষার্থীরা। বিভাগীয় প্রধান ডাক্তার নাজমুলের সাথে ওইদিন মর্গে গিয়েছিলেন প্রভাষকের দায়িত্ব পালনকারী ডাক্তার জেসমিন সুমাইয়া। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একাধিকবার ডাক্তার জেসমিন সুমাইয়াকে অনুরোধ জানিয়েছেন মহিলার লাশের ময়না তদন্তের জন্যে। কিন্তু সে অনুরোধ তিনি মানেননি। অবশ্য তিনি এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে গাইনী এন্ড অবস ডিগ্রির জন্যে লেখাপড়া করছেন।

বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত লাশের ময়না তদন্তের কাজে সবসময় ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের ডাক্তাররা দায়িত্ব পালন করবেন। একমাত্র তারাই ময়না তদন্তের কাজে ও মৃত্যুর সঠিক কারণ উৎঘাটনে সর্বাধিক পারদর্শী। দেশের জেলা ও উপজেলা হাসপাতাল গুলোতে ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তারদের পদ নেই। উপজেলা থেকে আবার লাশ পাঠানো হয় জেলা হাসপাতালের মর্গে। তাই অন্যান্য বিভাগের ডাক্তাররা কাজটি সারেন। তবে প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ আছে। ২৫০ শয্যা যশোর জেনারেল হাসপাতালটি ২০১১ সালের ৭ আগস্ট থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্বীকৃতি পাওয়ার সাথেই ফরেনসিক বিভাগটি সয়ংক্রিয়ভাবে ময়না তদন্তের কাজে দায়িত্ব পেয়েছে। দু’জন ডোমও নিয়োগ পেয়েছে। অথচ বিভাগটির প্রধানের দায়িত্বহীনতার কারণে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত শিক্ষা থেকে। আর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত স্বজনের মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য উৎঘাটন থেকে।

এ ব্যাপারে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহাকারী অধ্যাপক ডাক্তার এবিএম নাজমুল হুদার সাথে যোগাযোগ করা হয়। তিনি স্বীকার করেন যশোরে যোগদানের পর তিনি একদিনই মর্গে গিয়েছেন। কলেজ অধ্যক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া আছে নিয়মিত ময়না তদন্তের তদারকি তিনি করবেন না। শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের পাঠ্য পুস্তকের পাঠদান বিষয়ে তদারকিতে থাকবেন। পরীক্ষা গুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করবেন। তিনি আরও স্বীকার করেন ব্যবহারিক শিক্ষা তিনি শিক্ষার্থীদের দিতে পারেননি। প্রভাষকরাই দায়িত্বটি পালন করছেন। কেন দিতে পারেননি সে বিষয়ে তিনি বলেন, যশোর মেডিকেল কলেজে ফরেনসিকে পদের সংখ্যা ৬টি। একজন সহযোগী অধ্যাপক, দু’জন সহকারী অধ্যাপক ও তিনজন প্রভাষক থাকার কথা। কিন্তু তিনি সহকারী অধ্যাপকসহ আছেন মাত্র ২জন প্রভাষক। শিক্ষকের অভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে সচেষ্ট থাকবেন শিক্ষার্থীরা, যাতে ব্যবহারিক শিক্ষা সঠিকভাবে পান। আর লাশের ময়না তদন্তের ব্যাপারেও আন্তরিক হবেন তিনি।

এদিকে, যশোর মেডিকেল কলেজে চলমান অরাজক পরিস্থিতি রুখতে গতকাল দুপুর ১টায় জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছে পাঠানো স্মারকলিপি গ্রহণ করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সাবিনা ইয়াসমিন। স্মারকলিপিতে যশোরের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষ ৩২ নেতা স্বাক্ষর করেছেন। তারা হলেন মাস্টার নুর জালাল, জেলা জাসদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট রবিউল আলম, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুজ্জামান পিকুল, ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য ইকবাল কবির জাহিদ, সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ভিটু, প্রেসক্লাব যশোরের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক কল্যাণ সম্পাদক একরাম উদ-দ্দৌলা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি হারুন অর রশিদ, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার রাজেক আহমেদ, সাবেক কমান্ডার এ এইচএম মুযহারুল ইসলাম মন্টু, সিপিবির সভাপতি আবুল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের সভাপতি আমিরুল ইসলাম রন্টু, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ ইকবাল, কমিউনিস্ট নেতা ইলাহদাদ খান, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান মিন্টু, পৌর কাউন্সিলর মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তা, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব তোফাজ্জেল হোসেন, গোলাম মোহম্মদ, কামরুজ্জামান, কাজী আব্দুস সবুর, এম এ মান্নান, শেখ মাসুদুর রহমান মিঠু, আবুল হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান, আরমান হোসেন,  মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক বাকু, এডভোকেট মহিউদ্দিন আহমেদ মহিন, যোসেফ সুধীন মন্ডল, মুক্তিযোদ্ধা এসএম আক্তারুজ্জামান, গোলাম মোস্তফা, এডভোকেট আবুল কায়েস, কামরুজ্জামান চৌধূরী ও সন্তোষ হালদার।